একটা সপ্তাহান্ত কি একটু অন্যভাবে কাটাতে চান?
ইঁট, কংক্রীট, ধুলো, ধোঁয়ার শহর ছেড়ে একটু দূরে? ব্যাস্ত জীবনে
হাজারো চাপে যখন দম বন্ধ হয়ে আসে, মন খোঁজে মুক্তি,
ক্ষণিকের হলেও।বাড়ীর থেকে
দুরে দুএকটা ছুটির দিন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে
আসার জন্য হোম স্টে এখন জনপ্রিয় ঠিকানা। হোটেলের মাপা নিখুঁত পেশাদারী পরিষেবা নয়,
বরং যেন ঘরের মানুষের
যত্নের ছোঁয়া, এতেই বাজীমাত
করছে হোমস্টে। গ্রামের সাদামাটা ঘর থেকে পারিবারিক প্রাসাদ বা কেল্লা, আপনার ইচ্ছা, রুচি আর পকেটের জোরের হিসেবে সব রকম পছন্দই
হাজির। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে,
ধীরে হলেও শুরু হয়েছে হোম
স্টের আয়োজন। শুধু গ্রামের সাধারণ বাড়ীই নয়, অতিথিদের জন্য দরজা খুলতে শুরু করেছে বেশ কিছু
প্রাচীন রাজবাড়ী এবং জমিদারবাড়ীও। পুরোন বনেদি পরিবারের আজকের প্রজন্মরা এগিয়ে
আসছেন তাঁদের বাড়ির ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আজকের পর্যটকের কাছে তুলে ধরতে। এছাড়া
প্রাসাদোপম বাড়ীর রক্ষণাবেক্ষণের বিপুল ব্যায়ভার অন্ততঃ কিছুটা লাঘব হয় পর্যটকদের
আনাগোনা বাবদ আয় থেকে। এই সব পরিবারের একদা বিপুল বিত্তের উৎস ছিল জমিদারি অথবা
ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য। কালচক্রের ফেরে সেই জমিদারীও আজ নেই, আর সেই ব্যাবসায়িক প্রতিপত্তিও অনেকাংশে
অস্তমিত। বর্তমান প্রজন্মের কেউ হয়ত দেশে বা বিদেশে চাকুরিরত অথবা নিজস্ব কোন ব্যাবসায় জড়িত। এছাড়াও শরিকি
ভাগাভাগি আর মামলা মোকদ্দমার জেরেও বহু বাড়ি অবহেলায় পড়ে থাকে। এর মধ্যেই আশার কথা
ইদানিং বেশ কিছু এমন পরিবারের লোকেরাই একজোট হয়ে বাড়ী সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য
খুলে দিচ্ছেন। এর মধ্যে বর্ধমানের ইটাচুনা রাজবাড়ী, কলকাতার উপকন্ঠে বাওয়ালী রাজবাড়ী বা নদীয়া
জেলার বালাখানা পর্যটকদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। পর্যটকদের পাওনা হল ছোট্ট
ছুটির ফাঁকে বিগতদিনের সেই সাতমহলা বাড়ীর
প্রাচুর্যময় বিলাসী জীবনযাপনের একমুঠো অভিজ্ঞতা। স্ত্রী ছবিতে হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে সেই বিখ্যাত গানটির লাইন ধার করে বলতে পারি, খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের মধ্যে এই পৃথিবীটা ঠিক
কেমন ছিল তার একটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে এখানে কিছুটা সময় কাটালে।
ঠিক এমনিই এক অবসরের ঠিকানা বর্ধমানের আমাদপুর
গ্রামে চৌধুরিদের জমিদারবাড়ি। মেমারী শহরের অনতিদুরে এই গ্রামে চৌধুরী পরিবারের
বসবাস বহুদিনের। বাড়ীর ডাইনিং হলে পরিবারের একটা বংশ লতিকা টাঙানো আছে। সেটি দেখলে
বোঝা যায় এনাদের আদি পদবী চৌধুরী নয়। চৌধুরী হল এঁদের উপাধি। এনারা আদতে ছিলেন
সেনশর্মা। বংশ লতিকায় প্রথমে নাম পাওয়া যাচ্ছে জনৈক শ্রীবৎস সেনশর্মার। তাঁকে এই
বংশের আদি পুরুষ ধরলে প্রায় ৯০০ বছর আগের কথা। এনার নাতি ছিলেন দুহি সেনশর্মা,
সম্ভবতঃ এই বংশের সবচেয়ে
গৌরবাণ্বিত পুরুষ। অসামান্য কাব্যপ্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি ছিলেন রাজা লক্ষণ
সেনের সভাকবি। সেই হিসেবে ধরতে গেলে ইনি গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেবের
সমসাময়িক। এর পরে সম্ভবতঃ ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়,
যখন পঞ্চম মুঘল বাদশা শাহ জাহান দিল্লীর মসনদে,
সেই সময় নাগাদ সম্রাটের
ফরমানে এই পরিবার বর্ধমানের এক বিস্তৃত অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন। সেই সময় থেকেই
চৌধুরী উপাধি নিয়ে এই পরিবারের রমরমার শুরু। ভবিষ্যতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে,
১৭৯৩ সাল নাগাদ এঁদের
জমিদারি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় আসে যার শেষ হয় স্বাধীন ভারতে জমিদারি প্রথা
অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। বর্তমানে সারা আমাদপুর গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে চৌধুরী
পরিবারের জমিদারির নিদর্শন। এখন গ্রাম অনেক বদলেছে,
পাকা বাড়ীও অনেক,
যার মধ্যে বেশ কিছু এই বংশের শরিকদেরই। আমাদপুর
হাই স্কুলের পত্তন হয় এই পরিবারের আর এক কৃতী পুরুষ মহেশ চন্দ্র চৌধুরীর হাতে,
১৮৫৫ সালে। এই স্কুলের
উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
|
বৈঠক্ খানার দেওয়ালে চৌধুরিবাড়ির বংশলতিকা |
এই পরিবারের উত্তরসূরি শিলাদিত্য চৌধুরি
পারিবারিক বাড়ির একটা অংশ মেরামত করে সাজিয়ে গুছিয়ে খুলে দিয়েছেন পর্যটকদের জন্য।
প্রায় তিনশ ছিয়াশি বছরের পুরনো বাড়ীর বিশাল বিশাল ঘর,
কড়িকাঠ বসানো উঁচু সিলিং,
ফ্লোর থেকে ওঠা প্রমাণ সাইজের খড়খড়ি আর কাঁচ
বসানো কাঠের ফোল্ডিং পাল্লা দেওয়া জানলা,
ঘরের ভিতর ভারী মেহগনি কাঠের ওপর সুক্ষ কারুকার্য করা উঁচু পালঙ্ক,
গা এলিয়ে দেওয়ার ইজি চেয়ার,
বেলজিয়ান গ্লাসের আলো ঠিকরানো মানুষ প্রমাণ
আয়না,
মার্বেল টপের টেবিল,
চকচকে পালিশ করা কাঠের
আলনা আর চেস্ট অফ ড্র্য়ার্স,
এখনো সেই যুগের বিত্তবৈভবের সাক্ষী হয়ে রয়ে
গেছে। বৈঠকখানার সিলিং থেকে ঝোলা,
রঙ বেরঙের
ঝাড়বাতির বাহার,
সাজানো কাঠের
পুতুল,
দেওয়ালে ঝোলানো
ফ্রেমে এখনো বাঙ্ময় ফেলে আসা দিনের বিভিন্ন পারিবারিক মুহূর্ত্তের সাদা কালো সব
ছবি,
সব মিলিয়ে সময় যেন থমকে
দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়ীর চার দেওয়ালের মধ্যে।
|
বৈঠক খানা |
|
বৈঠক খানায় কড়ি বরগার সিলিং এ ঝাড়বাতি। |
|
ডাইনিং হল |
|
ঝাড় বাতির বাহার |
এখানে থাকলে অনুভূতি হয় যেন জীবনের গতি
স্লথ হয়ে এসেছে,
দৈনন্দিন ব্যাস্ত
জীবনের ছোঁয়া থেকে বহুদুরে এ যেন এক অন্য বিলাসী জগৎ। দোতলার জানলার বাইরে তাকালে
চোখে পড়ে শুধু ঘন সবুজ গাছের মাথা,
দিনে দুপুরে ভেসে
আসে পাখির ডাক। অলস দুপুরে দূর থেকে কুব কুব করে একটা পাখি ক্লান্ত ঘুমপাড়ানি
স্বরে একটানা ডেকে যায়। বাড়ীর উত্তরপানে ২৪ বিঘার দিঘী,
চতুর্দিকে সবুজ বনে ঘেরা। কাজল কালো জল কখনো
হাওয়ায় তির তির করে কাঁপে,
আবার কাজলা দিঘী
কখনও যেন আয়না,
স্থির জলে আকাশের
প্রতিবিম্ব। মাঝে মাঝে দিঘীর জলে ঘাই মেরে যায় মাছ। বাঁধানো পাড়ে চুপচাপ চায়ের কাপ
হাতে বসে কেটে যেতে পারে সন্ধ্যেটা।
আলো মরে এলে ঘাটের পিছনে সিল্যুট হয়ে দাড়িঁয়ে
থাকবে উঁচু বেদির উপর রাসমঞ্চ। আঁধার
ঘনালেই পিছনের মন্দির থেকে ভেসে আসবে সান্ধ্যপুজার শাঁখ ঘন্টার আওয়াজ। বাড়ীর মুল
দরজার সামনের চত্ত্বরে রাসমঞ্চকে মধ্যমণি করে দুদিকে দুটি করে জোড়ায় আটচালা মন্দির,
লাল রঙ করা,
সামনে কিছু টেরাকোটার কাজ। এগুলি শিবমন্দির।
|
সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস মঞ্চ |
|
মুল বাড়ির প্রবেশপথ এবং দু ধারের মন্দির |
ডান দিকের মন্দির গুলির পিছনেই পারিবারিক দেবী আনন্দময়ী মায়ের মন্দিরের বাইরের
পাঁচিল। দেবী পুজিত হন কন্যারুপে। মন্দিরের নির্মাণ এবং দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন
বংশের পুর্বপুরুষ মোহন চন্দ্র চৌধুরী। দেওয়াল ঘেরা মন্দির চত্ত্বর বাঁধানো,
ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে
মুল মন্দিরে। গর্ভগৃহে আনন্দময়ী মায়ের বিগ্রহ। কালীরুপী প্রতিমা,
নীচে শায়িত শিব আর চতুর্ভূজা দেবী তাঁর উপর
পদ্মাসনে অধিষ্ঠিতা। নিত্যপূজা হয় আর
সান্ধ্য আরতি। গ্রামের অনেক মানুষ আসেন আরতির সময়।
|
বাড়ির পাশেই পারিবারিক দেবী আনন্দময়ী মায়ের মন্দির |
চৌধুরী পরিবারের নিজস্ব মন্দিরগুলি ছাড়াও এই
গ্রাম এবং এর আশেপাশে ছড়িয়ে আছে আরো বেশ কিছু মন্দির। এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ভাব ধারার
প্রভাব চোখে পড়ার মত। সেই সুদূর ১৪৮৬ সালে নবদ্বীপে জন্মানো মানুষটি সব সনাতন
ভাবনাচিন্তা,
সংকীর্ণতা কে
তছনছ করে সারা বাংলাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ারে। শ্রী চৈতন্যদেবের সেই
প্রেমজোয়ারের ঢেউয়ের অভিঘাত পৌঁছেছিল এই অঞ্চলেও। তারই এক নিদর্শন চৌধুরীবাড়ী থেকে
দুপা হাঁটা পথে রাধামাধব মন্দির। বৈষ্ণব ধর্মভাবনায় অনুপ্রাণিত এই গ্রামের সেরা অসাধারণ
টেরাকোটার কাজ সমৃদ্ধ মন্দির। তিনটি খিলানযুক্ত্ মন্দিরের সামনের দেওয়াল এবং
পিলারে অপুর্ব সব টেরাকোটার প্যানেল,
শিল্পী পরম যত্নে পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী টেরাকোটায় জীবন্ত করে তুলেছেন।
|
রাধামাধব মন্দিরে টেরাকোটার কাজ |
|
রাধামাধব মন্দিরের গর্ভগৃহ |
কত পুরনো এই মন্দির তার আন্দাজ পাওয়া কঠিন,
কোন প্রতিষ্ঠা ফলকও চোখে
পড়ে নি যার থেকে মন্দিরের সঠিক বয়স জানা যেতে পারে। পুরোহিতের মতে মন্দিরটি প্রায়
পাঁচশ বছরেরও বেশী পুরোন। টেরাকোটার কাজগুলি কাছে থেকে নজর করলে বোঝা যায় অনেক
পুরোনো আমলের,
বাংলার মন্দিরে
মন্দিরে টেরাকোটার কাজের চল যখন শুরু হচ্ছে সেই প্রথম যুগের কাজ। এটা অবশ্য বিশেষজ্ঞরাই
ভালো বলতে পারবেন। গর্ভগৃহে রাধা মাধবের যুগল বিগ্রহ। সামনে মার্বেলে বাঁধানো
নাটমন্দির। উপরে নীল রঙের কড়িবরগার সিলিং। মার্বেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ধুপ ধুনোর
গন্ধে,
ঘন্টার আওয়াজে
সন্ধ্যা আরতি দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
|
নাট মন্দির, রাধামাধব মন্দির আমাদপুর |
এই দালানেই বসে কীর্তনের আসর। এই গ্রামের
অন্যতম প্রধান উৎসব হল রাস। এই সময় রাধা কৃষ্ণের যুগল বিগ্রহকে মহা সমারোহে নিয়ে
যাওয়া হয় দিঘীর ধারে চৌধুরীবাড়ীর রাসমঞ্চে। তিনদিন ধরে চলে এই আনন্দ উৎসব। নাম
সংকীর্তন,
কবির লড়াই,
যাত্রাসহ নানা অনূষ্ঠানে
মেতে ওঠেন গ্রামের আপামর মানুষ। এই তিনদিনে রাধা কৃষ্ণকে সাজানো হয় যথাক্রমে
রাজবেশ,
রাখালবেশ এবং
নটবরবেশ এই তিন রকম রুপে। এছাড়াও রাধা কৃষ্ণকে ঘিরে এখানের মানুষ আরেকবার আনন্দে
মাতেন দোল যাত্রার সময়। প্রথা অনুসারে রাধাকৃষ্ণর বিগ্রহকে রাখা হয় দোলনায়,
রাসমঞ্চের কাছে। এই
সময়তেও রঙ খেলার সঙ্গে সঙ্গে গান বাজনা,
সংকীর্তন চলে দিন ভোর।
এই গ্রামে আরো একটি আটচালা মন্দির দেখা যায় যার
সামনের দেওয়ালে বেশ কিছু টেরাকোটার কাজ আছে। কালের প্রভাবে ক্ষয়ে এলেও কাজের সুক্ষতা
কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এই মন্দিরটি গোপাল মন্দির নামেই পরিচিত। এর বৈশিষ্ট্য হল
কাঠের গোপাল মুর্তি। গোপাল এখনো নিত্য পুজা পান। মুল দরজার উপর প্রতিষ্ঠা ফলক থেকে
দেখা যায় মন্দিরটি তৈরী হয়েছিল বাংলা ১১৩৭ সনে অর্থাৎ প্রায় ২৮৭ বছরের পুরোন
মন্দির।
|
দুর্গা দালান চৌধুরি বাড়ি আমাদপুর |
|
দুর্গা দালান চৌধুরি বাড়ি আমাদপুর |
|
দুর্গা দালান চৌধুরি বাড়ি আমাদপুর |
দুর্গাপুজোর বিসর্জনের একটা বিশেষ আকর্ষণ
এখানে আছে। চৌধুরী পরিবারের জমিদারীর পত্তনের পরে পরে অনেক আদিবাসী এবং নিম্ন
সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এসে ঘর বাঁধেন প্রজা হিসাবে। এখনও গ্রামের মধ্যে আছে
আদিবাসীপাড়া যেখানের বাসিন্দারা মুলতঃ সাঁওতাল বা অনান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের
মানুষ। চৌধুরী পরিবারের দুর্গা এবং কালী পুজায় এঁরা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন বহুদিন
থেকেই। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় এঁদের নিজস্ব ঘরানার নাচ দেখার মত। বিসর্জনের দিন
এখানে বাইরে থেকে হাজার হাজার মানূষ আসেন এই শোভাযাত্রা দেখার জন্য। এছাড়াও চৌধুরী বাড়ীতে এবং গ্রামেও কালীপূজাও
খুব ধুমধাম করে হয়। এই গ্রামে তিন প্রধান কালীপূজা,
বড়কালী,
মেজোকালী এবং সেজোকালী। এইসময়ও থাকে আদিবাসী
নৃত্য। তাঁরাই ঢাকের তালে নাচতে নাচতে বয়ে নিয়ে আসেন প্রতিমাকে। এছাড়াও
চৌধুরীবাড়ীর রথ যাত্রাও বিশেষ দ্রষ্টব্য। বাড়ীর নিজস্ব রথ সাজিয়ে গুজিয়ে
মহাসমারোহে জগন্নাথদেব,
সুভদ্রা আর
বলরামকে ঘোরানো হয়। বছরের অন্য সময় লোহার রথের কাঠামো রাখা থাকে বাড়ীর কাছেই এক
পুকুরধারে।
|
চৌধুরিবাড়ির রথ |
আমাদপুরে এলে আর একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য জায়গা হল
নি:শঙ্ক আশ্রম যা নরহরি বাবার আশ্রম বলেও পরিচিত। চৌধুরীবাড়ী থেকে কয়েক কিলোমিটার
দূরে। যাওয়ার পথে পড়বে এই গ্রামের আদিবাসী পাড়া। খুব সুন্দর গ্রামের রাস্তা,
লোকবসতি ছাড়ালেই আদিগন্ত
ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা গেছে। এটি আদতে একটি বৈষ্ণব আখড়া।
|
নিঃশঙ্ক আশ্রম আমাদপুর |
লোকমুখে প্রচলিত আছে
প্রায় পাঁচশ বছর আগে নরহরি বাবা বলে একজন সাধক এই স্থানে আসেন সাধনার জন্য। সেইসময়
এই পুরো অঞ্চলটা ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা,
এবং সেই জঙ্গলে নাকি বাঘও থাকত। এই বনের মধ্যে এক বটগাছ তলায় থানে বসে সাধনা
করে নরহরি বাবা সিদ্ধি লাভ করেন এবং এখানেই তাঁর আশ্রম্ স্থাপনা করেন। তিনি নাকি
যোগবলে বাঘকেও পোষ মানাতে পারতেন। আশ্রমে গেলে নরহরি বাবার ছবি দেখা যায় যেখানে
দুপাশে দুটি বাঘ নিয়ে তিনি সিদ্ধাসনে বসে আছেন। অবশ্যই হাতে আঁকা।
|
নরহরি বাবার সেই ছবি |
মুল মন্দিরের
ভিতরে বেদিতে বসানো মালাগলায় শ্রীচৈতন্যদেবের কৃষ্ণভাবে সংকীর্তনরত মুর্তি। তার
সামনেই জগন্নাথ,
সুভদ্রা আর
বলরামের বিগ্রহ। রোজ সন্ধ্যাবেলা আশ্রম চত্বরে বসে নামগানের আসর। এছাড়াও বিশেষ
বিশেষ উৎসবের দিনে বহু ভক্তসমাগম ঘটে।,
খিচুড়িভোগের ঢালাও আয়োজন থাকে। আশ্রমের পরিবেশটিও বড় মনোরম। মুলদরজা দিয়ে
ঢুকেই পাঁচিলঘেরা বিরাট কম্পাউন্ড,
শেষপ্রান্তে
মন্দির এবং আশ্রমের পাকা বাড়ী। পিছনদিকে কেয়ারি করা ফুলের বাগান। বেশ কিছু ফলের
গাছ এবং ওষধি গাছও রয়েছে। পাশেই আশ্রমিকদের থাকার ঘর। বাহুল্য নেই,
কিন্ত পরিচ্ছন্ন,
ঝকঝক করছে।
|
সন্ন্যাসীদের বাসস্থান, নিঃশঙ্ক আশ্রম আমাদপুর |
|
আশ্রম চত্ত্বরে কাঁঠাল গাছ |
|
আশ্রমের বাগানে সাদা গোলাপ |
আশ্রমের সামনের কম্পাউন্ডের ডানদিকে
কয়েকটি ধানের মরাই,
তার পাশেই এক
বিরাট অশ্বত্থগাছের ছায়ায় বেশ কিছু সমাধিমন্দির,
অনেকটা যেন চারচালা মন্দিরের ক্ষুদ্র সংস্করণ।
সবকটিই এখানকার মহন্তদের,
যাঁরা বিভিন্ন
সময় আশ্রমের দ্বায়িত্ব সামলেছেন। নরহরি বাবার সমাধি মুল আশ্রমের ভিতর।
|
নরহরি বাবার সমাধি মন্দির |
আশ্রমবাড়ীর
পাশদিয়েই ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে চলার পথ গেছে সেই পবিত্র বটগাছতলায় যেখানে
বসে নরহরি বাবা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি। হাঁটাপথটি ভারী সুন্দর,
আশ্রম ছাড়ালেই যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজ ক্ষেত।
এখন আলুর মরশুম। ক্ষেতে আলু তুলে মহিলারা বস্তাবন্দি করছেন দ্রুত হাতে। পাশে
দাঁড়িয়ে থাকা ট্র্যাকটারে লাগানো ট্রেলারে লোড হয়ে যাচ্ছে লাল রঙের নাইলনের আলুর
বস্তা,
বাজারে বা হিমঘরে
পাঠানোর জন্য।
|
আশ্রম ছাড়ালেই বিস্তির্ণ আলুর ক্ষেত |
|
মাঠেই চলছে আলু বস্তাবন্দী করার কাজ |
দেখতে দেখতে চলেছি,
এইসময় দূর থেকেই
চোখে পড়ল মাঠের মধ্যে একটা ঝুপসি বটগাছ। তার কান্ড,
উপকান্ড,
ঝুরি নামিয়ে বেশ বড় জায়গা জুড়ে সে যেন নিজেই
তৈরী করেছে এক অরণ্য। অনেকটা যেন আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রাচীন বটের
ক্ষুদ্র সংস্করণ। ভিতরটা দিনের বেলাতেও আবছা অন্ধকার,
অসংখ্য ঝুরির মাঝে যেন এক ভুলভুলাইয়া। এরমধ্যেই
রয়েছে একটা লালরঙের বেদী। গাছের শেকড় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে,
যেন গিলে নেবে। একপাশে একটি হোমকুন্ড। এই
বেদীতে সাধনা করেই নাকি নরহরি বাবা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস,
এই পবিত্র বটতলায় কোনকিছু
কায়মনবাক্যে চাইলে নাকি ভক্তের মনষ্কামনা পূর্ণ হয়,
তাই এর নাম '
কল্পতরু সিদ্ধবটতলা'
। পুরো জায়গাটায় একটা অদ্ভুত ঠান্ডা পরিবেশ,
হয়ত রোদের আলো ঠিকমতো
ঢোকেনা বলে একটা শীতল ভাব। শুধু প্রকৃতির নিজস্ব কিছু শব্দ যেমন পাতা নড়ার সর সর
আওয়াজ,
কখনো পাখির ডাক
আর পোকামাকড়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। এই আধো অন্ধকারে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে মন যেন আপনা
থেকেই শান্ত হয়ে আসে। আমি নিজে সেভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী নই,
কিন্তু জায়গাটার সৌন্দর্য বা নির্জনতার যার
প্রভাবেই হোক মনটা অকারণেই হালকা হয়ে যায়,
দৈনন্দিন জীবনের হাজারো চিন্তাভাবনা,
ঝঞ্ঝাট গুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য হলেও যেন মন থেকে সরে যায়। এটা
স্থানমাহাত্ব্য না ঈশ্বরভাবনা,
কোনটা ঠিক জানি
না কিন্তু কিছুক্ষণ বসার পর কেমন যেন অজানা
একটা ভালোলাগার বোধ নিয়েই জায়গাটা ছেড়েছিলাম।
|
কল্পতরু সিদ্ধবটতলায় নরহরি বাবার সাধন স্থান। |
|
কল্পতরু সিদ্ধবটতলা পুজাবেদী |
|
কল্পতরু বটের বিস্তার |
সন্ধ্যার ঝোঁকে ফেরার পথে গ্রামে দেখলাম একটি
বাড়ির সামনে স্বামী স্ত্রী মিলে দোকান খুলে বসেছেন। গরম গরম শিঙাড়া আর ভেজিটেবল চপ
ভাজা হচ্ছে। বাইরের মানুষ দেখে খুশি হয়ে খুব আদর যত্ন করেই বেঞ্চে বসালেন। খবরের
কাগজের মোড়কে সদ্য ভাজা গরম গরম সিঙ্গাড়া আর চপের স্বাদ বহুদিন মনে থাকবে। মাত্র
তিন টাকা করে একএকটা,
আমাদের মতো শহুরে
মানুষের কাছে একটু বিস্ময়ের ব্যাপার বই কি।
|
গ্রামের পথে সিঙ্গারা আর চপের দোকান, এই দুর্মূল্যের বাজারেও তিন টাকা প্রতি পিস |
|
গরম গরম অমৃত, ভেজিটেবল চপ আর সিঙ্গাড়া, |
চৌধুরীবাড়ীর অতিথিদের জন্য খাওয়া দাওয়ার
ব্যাবস্থাও বেশ ভালো। ভালো বলতে সাধারণ বাঙালী মেনু, ডাল, ভাত, বেগুন ভাজা,
পোস্ত, ঋতুকালীন সব্জীর তরকারী, মাছ, মুরগী বা পাঁঠার মাংসের পদ যত্নের সঙ্গেই খাওয়ানো হয়। সকালের ব্রেকফাস্টে
ফুলকো লুচি আর সাদা আলুর তরকারি বেশ ভালোই জমবে। মেনুর বাহুল্য নেই কিন্তু রান্না
ভালো। স্থানীয় গ্রামের মানুষ্ জনই রান্নার এবং পরিবেশনের দ্বায়িত্বে আছেন। নিচে
ডাইনিং হলের বড় মেহগনি কাঠের টেবিলে বসে ওঁদের নিজস্ব এনগ্রেভ করা কাটলারীতে
খাওয়ার অভিজ্ঞতা মনে থাকবে।
পথের হদিসঃ
সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন অনায়াসেই।
কলকাতা থেকে দুরত্ব একশো কিলোমিটারও নয়। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে যেতে হবে।
মাঝখানে হিন্দুস্থান ধাবায় দাঁড়িয়ে অমৃতসরি কুলচার স্বাদ নিতে পারেন, বেশ ভালো বানায়। এরপর পালশিটের টোল প্লাজা
পেরিয়েই একটা রাস্তা কেটে গেছে ডান হাতে। এই রাস্তা ধরে কিলোমিটার পাঁচেক গেলেই
পড়বে পুরোন দিল্লী রোড। এখান থেকে আবার ডান দিকে বেঁকে চলতে হবে কলকাতার দিকে মুখ
করেই। কিছুক্ষণ পরেই আসবে লেভেল ক্রসিং। এটা পেরিয়ে একটু এগোলেই মুল রাস্তা থেকে
বাঁ দিকে একটা শাখা কেটে চলে যাচ্ছে গেছে মেমারী শহরের দিকে। এই বাঁ দিকে রাস্তাটা
ধরে পাঁচশো মিটার এগোলেই আবার একটা রাস্তা পাওয়া যাবে বাঁ দিকে যেটা সোজা চলে গেছে
আমাদপুর। এই রাস্তা ধরে পাঁচ কিলোমিটার মত
সোজা চালালেই পৌঁছে যাবেন আমাদপুর হাইস্কুল। স্কুলের সামনে দিয়েই রাস্তা
গেছে চৌধুরী বাড়ীর দিকে, স্থানীয় কাউকে
জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবেন। শেষের রাস্তাটুকু খুব সুন্দর। এখানে অনেকগুলি পুকুর
আছে, আর দেখতে পাবেন বড় বড়
আমবাগান। ঘোর গ্রীষ্মেও ছায়া দেয় ঘন পাতায় ঢাকা আমগাছগুলো।
যাওয়া যেতে পারে বছরের যে কোন সময়েই, তবে শীতকালে গেলে ভালো। আশেপাশে ঘুরতে সুবিধা
হয়, আর কষ্টটাও কম হবে। একদম
গরমের সময়টা এড়িয়ে বাকি সব ঋতুতেই যাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে ঘন বর্ষায়
গ্রামবাংলার রূপ অনবদ্য হয়। তবে বিশেষ বিশেষ উৎসবের দিনগুলি যেমন, দুর্গাপূজা, কালীপূজা, রথযাত্রা ইত্যাদি এড়িয়ে চলাই ভালো। যেতে অবশ্যই
পারেন কারণ এখানের উৎসব গুলিই দেখার মত, কিন্তু এই সব পালাপার্বনের দিনে চৌধুরীবাড়ীতে বাইরে থেকে বহু আত্মীয় স্বজন
আসেন সেজন্য পরিবারের লোকেদের জায়গা করে দিতে ঘরগুলি এনারা হোমস্টে হিসেবে বাইরের
অতিথিদের ভাড়া দেন না। তবে মেমারী শহরের কোন হোটেলে থেকে আমাদপুরে এসে উৎসব দেখাই
যেতে পারে, মেমারী শহর থেকে
দুরত্ব সাত আট কিলোমিটার মাত্র।
বুকিং করার খুঁটিনাটিঃ
চৌধুরী বাড়ীতে পর্যটকদের জন্য আছে চারটি ঘর। এর
মধ্যে দুটি ডাবল বেড এবং দুটি ফোর বেডেড। ঘরে এসি আছে, তবে পাওয়ার কাট হলে চলবে
না। ঘরের ভাড়া যথাক্রমে ৩০০০/- এবং ৫০০০/- টাকা। এর মধ্যে খাওয়া ধরা নেই। এই রেট
মার্চ ২০১৮ এর, তবে যাবার আগে
চেক করে নেবেন।
বুকিং এর জন্য যোগাযোগ করতে হবে শিলাদিত্য
চৌধুরির সঙ্গে। সজ্জন মানুষ, চৌধুরী পরিবারে
মুলতঃ এনার উদ্যোগেই হোমস্টে শুরু হয়েছে। ওনার সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা আর ফোন নম্বর
নিচে রইল।
Chaudhuribari Heritage Homestay at Amadpur near Memari Burdwan
Phone : (033)-24860513
Mobile : +91 9831031183 | +91 9836731183
Email : contact@heritageamadpur.com | chaudhuris1@gmail.com
এছাড়াও আমাদপুরের যাবতীয় খবরের জন্য ক্লিক করুন
নিচের ওয়েবসাইটে।
উপরের লেখাটিতে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে লেখক পরিবেশিত তথ্যের সত্যতা নিয়ে কোন দাবী করছেন না কারণ এর সমস্তটাই স্থানীয়
মানুষের মুখে শোনা। কোন নির্ভরযোগ্য সরকারী বা বেসরকারী সূত্র থেকে যাচাই করা নয়।
চৌধুরী বংশের ইতিহাস ওনাদের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে।