Saturday, December 4, 2021

PAHARPUR ECO RESORT; PURULIA




PAHARPUR ECO RESORT PURULIA

চলো দিকশূণ্যপুর।

যারা জীবনে কখনো দিকশূন্যপুরে যায়নি, কিংবা সে-জায়গাটার নামও শোনেনি, তারা বুঝতে পারবে না তারা কী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার অস্তিত্বই জানা নেই, তাকে না-পাওয়ার তো কোনো দুঃখ থাকে না। কিন্তু যারা দিকশূন্যপুরে একবার গেছে, কিন্তু বারবার ফিরে যেতে পারেনি, তাদের অতৃপ্তির শেষ নেই। আমি মাঝে মাঝে সেই জায়গাটার কথা ভাবি, কিন্তু আমারও যাওয়া হয়ে ওঠে না। কেউ আমাকে ডেকে নিয়ে যায় দক্ষিণে, কেউ উত্তরে।”

বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী পাঠকের হয়ত উপরের প্যারাটা চিনতে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না। হ্যাঁ এ নীলু মানে  নীললোহিত আর দিকশূণ্যপুরের গল্পই বটে৷ নীললোহিতকে বলা যেতে পারে সুনীলের অল্টার ইগো, লেখক সুনীলকে ছাপিয়ে তাঁর ভিতরের বোহেমিয়ান কবিসত্বাই তাঁর কলমে নীললোহিত চরিত্রের মধ্যে ফুটে উঠেছে।

এই নীললোহিত হয়ত আমাদের বড়ই কাছের, বড্ড যেন চেনা। নিত্যদিনের ঘরের এবং বাইরের যত ব্যস্ততা, জীবনের যা কিছু দায়দ্বায়িত্ব, অস্তিত্বের লড়াই, সব কিছুর নিচে, সবার বুকের কোন গভীর কন্দরে হয়ত একটা ২৭ বছর বয়সে আটকে থাকা উড়নচন্ডী নীলুর সুপ্ত স্বত্তা ঘুমিয়ে থাকে। যে কাঠবেকার, মানিব্যাগ পর্যন্ত সাথে রাখে না, হাওয়াই শার্টের বুকপকেটে দু চার টাকা ছাড়া আর কিছুই সম্বল নেই, শহর জীবনে হাঁপিয়ে উঠলে, বড়ো কোন সমস্যা দেখলেই সে মুক্তির খোঁজে ছোটে দিকশূণ্যপুরে। এই দিকশূণ্যপুরে একবার গেলে কেউ ফেরে না, সবাই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলেই যায়। বন্দনাদি, বসন্ত রাও, জয়দীপ, রোহিলা, এই চরিত্রগুলির কেউ ফিরে আসেনি। ব্যতিক্রম শুধু জন্ম বোহেমিয়ান নীললোহিত, সে বারবার যায়, আবার ফিরেও আসে। তার কাছে জীবন বন্ধনহীন, জঙ্গম, হুটহাট বেরিয়ে পড়া আছে কিন্তু কোথাও থিতু হওয়া নেই। দিকশূণ্যপুর তার কাছে সাময়িক স্বস্তি, মনের আরাম, ব্যস ওইটুকুই।

আসলে সব মানুষেরই এমন একটা মুক্তির ঠিকানা দরকার, একটা পালিয়ে যাওয়ার আশ্র‍য়। জীবনযুদ্ধে ক্রমাগত জিততে জিততে মাঝে মধ্যে হেরে যাওয়ারও প্রয়োজন আছে। ক্রমাগত জিতে আসা মানুষের অনুভূতি হয়ত কিছুটা ভোঁতাই হয়ে যায়, তাই মাঝে মধ্যে হেরে যাওয়া, পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে নিজের মধ্যেকার অন্যরকম অনুভূতিগুলোকে একটু নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগটাও মেলে। 

PAHARPUR_ECO-RESORT_PURULIA

দিকশূণ্যপুর আদতে কোন বিশেষ একটা জায়গা নয়, সব মানুষেরই একটা নিজস্ব দিকশূণ্যপুর থাকতে পারে, এমন কি একাধিকও। যেখানে পৌঁছতে পারলেই আত্মার আরাম, একটা বন্ধনহীন নিশ্চিন্ততাবোধ জড়িয়ে ধরে, যেখানে গেলে সব কিছু ভুলে প্রাণ খুলে, দুহাত ছড়িয়ে, খোলা গলায় "আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে" গাইতে ইচ্ছে করে সেটাই দিকশূণ্যপুর।  

PAHARPUR ECO RESORT PAHARPUR


নীললোহিতের দিকশূণ্যপুরের বর্ণনায় ভেসে বেড়ায় জঙ্গল আর টিলা পাহাড়ে ঘেরা এক ভূমি। সাঁওতাল পরগণা আর ছোটনাগপুরের জঙ্গল, নদী আর পাহাড়ের আনাচকানাচে সুনীলের বিবাগী বিচরণের ভালোবাসাতেই গড়ে উঠেছে তাঁর দিকশূণ্যপুর যেখানে নীললোহিতের চরিত্রের আড়ালে নিজেরই পালিয়ে যাওয়ার ঠিকানা রেখে গেছেন। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


আমিও খুঁজে গেছি আমার নিজস্ব দিকশূণ্যপুর।আমার দিকশূণ্যপুর একেবারেই মিলে যায় ছোটবেলায় পড়া নীললোহিতের উপন্যাসের বর্ণণার সঙ্গে। একটা বই পড়লে তার চরিত্র, লোকেশন সব মিলিয়ে পাঠকের মানসচক্ষে পরপর ছবি তৈরী হতে থাকে, আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমার কল্পনার দিকশূণ্যপুরের ছবি মস্তিষ্কে তীব্রভাবে গেঁথে আছে তার নিজস্ব রূপ নিয়ে। আমিও কাজে অকাজে অনেকবারই ফিরে ফিরে গেছি বাংলার রাঢ়ভূমের পথেপ্রান্তে, ঊড়িষ্যা, ঝাড়খন্ডের জঙ্গল পাহাড়ে, এ সব অঞ্চলের প্রকৃতি অকৃপণ মেলে ধরেছে নিজেকে, মুগ্ধ হয়েছি বারবার, কিন্তু কোন জায়গাই আমার কল্পনার সেই দিকশুণ্যপুর হয়ে উঠতে পারেনি। তবে যতবারই গেছি এসব অঞ্চলে, অবচেতন মন ঠিক খোঁজ চালিয়ে গেছে, ঠিকানা যদি পাই।

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


এবারে কিছুটা কাকতালীয়ভাবেই এক বন্ধু শ্রাবণীর সৌজন্যে পুরুলিয়ার একটা জায়গার ছবি দেখতে পাই, তার নামটাও ভারি সুন্দর, পাহাড়পুর। জায়গাটার ছবিগুলো দেখেই মনে হল এই তো সেই আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দিকশূন্যপুর, ভীষণ মিল আছে যেন।

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


অতএব আর দেরী নয়, নভেম্বরের শেষে শনি রবি ছুটির সঙ্গে সোমবার যোগ করে বেরিয়ে পড়লাম, এযাত্রায় বাহন আমার মোটরসাইকেল। প্রথমে ভেবেছিলাম, একলাই যাবো, এসব জায়গায় একাই যেতে হয় নিজের মতো করে, কিন্তু শেষ বেলায় এক বাল্যবন্ধুও সঙ্গী হল।

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

সকাল বেলায় কলকাতা থেকে বেরিয়ে ধীরেসুস্থে চালিয়ে আরামবাগ, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া, ছাতনা হয়ে, পাহাড়পুর, প্রায় ছঘন্টার পথ।  ডিটেইলস শেষে দিচ্ছি। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

ছাতনার পর আররা পেরিয়ে তালাজুড়ি থেকে বাঁদিকে পাহাড়পুরের রাস্তায় ঢুকেই বুঝলাম এখানেই আমার অভীষ্ঠ দিকশূন্যপুর, মনের ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, এতদিনে তাহলে পেলাম তারে।

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

ঢেউ খেলানো পাথুরে মালভূমি, খেজুর গাছের সারি, হালকা জঙ্গল, শাপলা ফুল ফুটে থাকা টলটলে দিঘী, এই সব পেরিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে একটা পাহাড়ের একদম  কোল ঘেঁষে। পাহাড়টাকে বেড় দিয়ে ঘুরে পিচ রাস্তা ছেড়ে বাঁয়ে কাঁকরের রাস্তায় নেমে, টায়ারে সরসর আওয়াজ তুলে, অল্প ঝাঁকুনি সামলে কিছুদূর গেলেই আমাদের গন্তব্য পাহাড়পুর ইকো রিসোর্ট, দিকশুণ্যপুরে থাকার একমাত্র ঠিকানা। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


রিসোর্ট শব্দটাতে আমার অবশ্য ঘোরতর আপত্তি আছে। পাহাড়পুরে এই আস্তানাটার সঙ্গে আর যাই হোক রিসোর্ট শব্দটা মানায়না। আসলে স্রেফ ভালোবাসায় গড়া এই  আস্তানাটির কোন নামই ছিল না,  কি করে যেন লোকের মুখে মুখে জায়গার নামের সঙ্গে মিলিয়ে পাহাড়পুর ইকো রিসোর্ট হয়ে গেছে। যদিও আদতে এটি একটি হোমস্টে বলা যেতে পারে। রিসোর্ট মানেই একটা নিপাট, নিটোল সাজানো-গোছানো জায়গা মনে আসে, প্রকৃতিকেও যেখানে মানুষের মর্জি মেনে মেক আপ করে সাজতে হয়, আর ট্যুরিস্ট যেন পাত্রপক্ষ, সাজানো মেয়েকে দেখতে আসছে। পেশাদারিত্বের মোড়কে যত্ন-আত্তির কোন খামতি নেই কিন্তু কোথাও যেন সেই প্রাণের সুর বাজে না। সে জায়গায় পাহাড়পুরের এই ঠেক  যেন কোন গ্রামের মাটির বাড়ির দাওয়ার মতো,  দুঃসহ গরমের দুপুরে ক্লান্ত অচেনা পথিককেও সেখানে শীতলপাটি বিছিয়ে দেওয়া হয়, ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে জল আসে, অবেলায়  উনুনে আঁচ পড়ে, ফুটে ওঠা ভাতের গন্ধে ম ম করে বাড়ি। দুটো সুখদুঃখের গল্পে মেঠো আত্মীয়তার মিঠে আবেশ জড়িয়ে থাকে। 

পাহাড়পুরে প্রকৃতি নিজের ছন্দে ছড়িয়ে আছে, কোথাও তার উপর খবরদারির চেষ্টা নেই। পুরো চত্ত্বর জুড়ে আপন খেয়ালে রঙ বেরঙের ফুল ফুটে আছে, সবুজ ঘাসের আস্তরণের মাঝে সন্তর্পণে বসানো ইঁটের পায়ে চলা পথ, একদিকে বড় একটা পুকুর, তাতে দিনরাত সামনের পাহাড়টার ছায়া পড়ে। কিছুটা জায়গায় চাষবাস হয় আর একদিকে সমকোণী ত্রিভুজের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি খড়ের চালার কটেজ। হ্যাঁ মাত্র তিনটি, বড়জোর ছ্য় সাতজন মানুষের স্থান সংকুলান হতে পারে। কারণ এখানে ভিড় কাম্য নয়, প্রকৃতিই এখানে মুখ্য, তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা কোথাও নেই।

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

কটেজগুলো সব স্থানীয় মাল মশলার ব্যবহারে স্থানীয় মানুষদেরই হাতে বানানো, যেমন তাঁরা গ্রামে নিজেদের বাড়ি বানান। উঁচু কৌণিক খড়ের ছাদ আর উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর কাঠের মেঝে যেমন উত্তাপ আটকায় তেমনি পুরুলিয়ার কড়া শীতেও ওম ধরে রাখে। এখানে বিলাস নেই, বাহুল্য নেই, কিন্তু আরাম আছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হল এখানকার কটেজ লাগোয়া বাথরুম। এর ডিজাইন এই হোমস্টের প্রাণপুরুষ অরিন্দমের ব্যতিক্রমী ভাবনার ফসল। এগুলোকে বলা যায় গার্ডেন টয়লেট, চারিদিকে পাঁচিলের ঘেরাটোপ থাকলেও মাথার উপর খোলা আকাশ, সূর্যের আলো আসে, আসে বাতাস, মাথার ওপর সবুজ চাঁদোয়া ধরে কলাগাছের পাতা, একপাশে টাইলস জায়গা ছেড়েছে মাটিকে, সেখানে ফুল ফুটে থাকে। বাড়ির বা হোটেলের বদ্ধ, নিওন বা এল ই ডির আলোয় আলোকিত বাথরুমের পর এই ওপেন বাথরুমটাই একটা আলাদা অভিজ্ঞতা।

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA
The Garden Toilet: Photo credit Paharpur Eco Resort Facebook Page

পাহাড়পুরে এসি নেই, টিভি নেই, রুম সার্ভিস নেই, মোবাইলের সিগন্যাল নিভুনিভু, ক্রমাগত লুকোচুরি খেলতে থাকে। তাই সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই যাবেন যে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া থেকে আপনার  কার্যতঃ ছুটি। বেড়াতে গিয়ে যাকে বলে সাইট সিয়িং, নাঃ তাও এখানে নেই। ব্যস্ততা নেই, এখানে জীবনের গতি শ্লথ। একটা বই হাতে বসে পড়ুন খড়ের চালায় ঢাকা খাবার জায়গাটার কাঠের চেয়ারে, পাশের ক্ষেতে দেখবেন হাল চষা হচ্ছে, চাষীর গলার হুররর হ্যাট হ্যাট আওয়াজের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে গরুর গলার কাঠের ঘন্টার আওয়াজ। এখান থেকে বেরিয়ে ডানদিকে কিছুদূর পায়েচলা পথ ধরে হেঁটে গেলেই দেখবেন তকতকে একটা আদিবাসী গ্রাম, এখানে স্থানীয় মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে এঁদের জীবনের রোজনামচা কিছুটা প্রত্যক্ষ করতে পারেন। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


এরপর পায়ে পায়ে আরকটু এগিয়ে চলে যান দ্বারকেশ্বরের কাছে৷ নদীর বেডে নেমে একটা জুৎসই পাথর বেছে নিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলা জলে পা ডুবিয়ে  বসে থাকুন। চাইলে স্নানও সেরে নিতে পারেন। নদীর অন্যপাড়ে ঘন জঙ্গল, রোজ বিকেলে আকাশে মুঠো মুঠো লাল আবির ছড়িয়ে সূর্য ওদিকেই ডুবে যায়। আর চাঁদনী রাত হলে তো কথাই নেই। চরাচর ভাসা চাঁদের আলোয় জনমানবহীন নদীর পাথুরে বুকে বসে থাকলে মনে হবে আপনি সেই আদিম পৃথিবীতে ফিরে গেছেন। রাত বাড়লে ঘরের বারান্দা থেকে উপরে তাকালেই দেখবেন কোটি কোটি তারা, দূষণহীণ নিকষ কালো আকাশে সপ্তর্ষীমন্ডল, কালপুরুষ  থেকে ছায়াপথ সবকিছুই দৃশ্যমান। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


আরো একটু অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছা জাগলে মিনিট পনেরোর দূরত্বে নামহীন টিলা পাহাড়টায় চলে যান। বেশ কাছাকাছি পর্যন্ত গাড়িও চলে যাবে। বাকিটা হাঁটা। এর চূড়ায় ওঠা খুব একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। টপে উঠলেই দেখতে পাবেন ইঁটের তৈরী প্রাচীন এক সেমাফোর টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ।  এর সঙ্গে বেশ কিছুটা ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এটাকে বলা যেতে পারে একধরনের অপটিক্যাল টেলিগ্রাফ৷ এক টাওয়ারের মাথা থেকে কাঠের প্যানেল ব্যবহার করে বিশেষ সাঙ্কেতিক ভাষায় খবর পাঠানো হত পরের টাওয়ারের মাথায় বসে থাকা মানুষকে। এটাই সেমাফোর (semaphore) সঙ্কেত।  সে আবার সেটা পড়ে নিয়ে আবারও একই সঙ্কেত ব্যবহার করে খবর পাঠাতো তারও পরের টাওয়ারে। এভাবেই টাওয়ারের পর টাওয়ার বেয়ে চলত সংকেতের ভাষা। ১৮১৬ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বারাণসীর কাছে চুনার দুর্গ পর্যন্ত খবরা-খবর আদানপ্রদানের জন্য মোটামুটি ১৩ মাইলের ব্যবধানে এরকম অনেকগুলি সেমাফোর টাওয়ার বসায়। কিছুদিন চলার পর টেলিগ্রাফ এসে যাওয়ায়  সেমাফোরের কাজ ফুরোয়। আজও অনেকগুলি টাওয়ার এমন ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়পুরের টাওয়ার তারই একটি। 

semaphore_tower_paharpur_purulia

semaphore_tower_paharpur_purulia

semaphore_tower_paharpur_purulia

semaphore_tower_paharpur_purulia

আবার এই পাহাড়টারই মাঝামাঝি জায়গায় একটা স্যাডল  মত আছে। সেখানে উঠে বসলে চতুর্দিকে একশ আশি ডিগ্রী ভিউ পাওয়া যায়। নিচে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত খোপকাটা সবুজ ধানক্ষেত, ইতিউতি খেজুর গাছের সারি আর দিগন্তে উটের কুঁজের মত জেগে থাকা আরেকটা পাহাড়, সব মিলিয়ে চমৎকার দৃশ্য। এখানে বসেই অনেকটা সময় কেটে যাবে।

PAHARPUR_ECO-RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


আর একজনের কথা না বললে পাহাড়পুর অসম্পূর্ণ। সে হল অরিন্দম দে, পাহাড়পুর যার নিজের হাতে তৈরী,  লো ইমপ্যাক্ট ট্যুরিজম নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্টও বটে। পরিবেশকে ভেঙ্গে নয়, জবরদখল করে নয়, বরং তার সাথে মিলেমিশে, সাসটেইনেবল এনার্জীর ব্যবহারে, স্থানীয় মানুষদের সাথে নিয়ে এটা একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম জার্ণি। আপনি যখন পাহাড়পুরের অতিথি তখন এই ইকোসিস্টেমের অংশ আপনিও। সেজন্যই প্রথমেই লিখেছিলাম, এটা রিসোর্ট নয়, সেভাবে ব্যবসায়িক মনোভাবে চলে না। স্রেফ বেড়ানোর আমোদ নয়, এখানে থাকা মানে অনেকটা যেন কোন নিকটজনের বাড়িতেই এসেছেন এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরা। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA
সুর্যালোকের ব্যবহারে জল গরম করার প্রাকৃতিক গিজার।

আর অরিন্দম? তার সঙ্গে খানিকটা মিল আছে নীললোহিতের পুর্বসুরী আর এক বিখ্যাত চরিত্র শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তর সঙ্গে, আবার কিছুটা হয়ত মিশেল আছে ওই উপন্যাসের আর এক বর্ণময় চরিত্র ইন্দ্রনাথের সঙ্গেও। একই রকমের ডাকাবুকো, একরোখা, মেধাবী অথচ আদ্যন্ত বাউন্ডুলে এক মানুষ। একে নিয়ে লিখতে বসলে এই লেখা আস্ত উপন্যাস হয়ে যাবে, ব্লগের কলেবরে আঁটবে না। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

শ্রীকান্ত জীবনকথা শুরুই করেছিল এই বলে:
‘‘আমার এই ‘ভবঘুরে’ জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে!"

তেমনই অরিন্দমের সঙ্গে সন্ধ্যের আড্ডায় বসলে কখন যে ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে মাঝরাতের গন্ডী পেরিয়ে যাবে বুঝতেই পারবেন না। ঝিঁঝিঁ ডাকা সন্ধ্যায়, ঢিমে আলোয়, মহুয়ার মাতাল নেশায় পাহাড় জঙ্গলের অ্যাডভেঞ্চারের গল্পে বুঁদ হয়ে থাকবেন। আপনাকে পছন্দ হলে অরিন্দম হয়তো নিজের হাতে বানানো ওয়াইনও খাইয়ে দেবে। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


আর শীতের ভোরে ঘুম ভাঙলে অপেক্ষা করবে সদ্য গাছ থেকে পাড়া খেজুর রস। কুয়াশা মাখা ভোরে ওয়াইন গ্লাস থেকে ঠান্ডা খেজুর রসে তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিচ্ছেন, দৃশ্যটা জাস্ট মনে মনে ভাবুন, এটাও পাহাড়পুরেই সম্ভব। সেই কাকভোরে পাহাড়তলীতে গাছ থেকে হাঁড়ি হাঁড়ি খেজুর রস নামিয়ে, খোলা আকাশের নিচে মস্ত উনুনে শুকনো খেজুরপাতা জ্বাল দিয়ে চলে নলেন গুড় তৈরির কাজ। অতি সস্তায়, চোখের সামনে বানানো, নির্ভেজাল ঝোলা গুড় নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন। 

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA




PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA


এইপ্রসঙ্গ টেনেই খাওয়া-দাওয়ার কথাটা তো বলতেই হয়, জন্মপেটুক আমি, এপ্রসঙ্গ কিভাবে এড়িয়ে যাবো? পাহাড়পুরের হেঁশেল সামলায়  এক ম্যাজিশিয়ান, তার নাম সুমন্ত। এমনিতেই এখানের শাক সব্জী সব ফ্রেশ, কেমিক্যাল সার বা কীটনাশক প্রায় ব্যবহারই হয় না, ফলে শহরে বসে আমরা যা পাই বা খাই তার সাথে তুলনাই চলে না। তার ওপর সুমন্তর হাতের গুণে সাধারণই অমৃত হয়ে ওঠে, তা সিম আলুর তরকারই হোক, বাঁধাকপি দিয়ে মাছের মাথা, চিকেন স্ট্যু, ঝালঝাল করে রাঁধা হাঁসের মাংস বা সন্ধ্যের চাটের চিকেন পকোড়া, যাদু সবেতেই। আর খেলাম একটা স্থানীয় মাছ, গ্রাস কার্প বলে, রুই মাছের তুতো ভাই, আর বেশ বড়সড় চেহারা। গ্রামের জেলেরা একদম জ্যান্ত ধরে পাহাড়পুরে পাঠিয়ে দেয়, তার টেস্টের কথা কি আর বলি। টাটকা মাছ খাওয়ার মজাই একদম আলাদা, জিভে পুরো স্বর্গ নেমে আসে। চালানি মাছ সে স্বাদের ধারেকাছেও যায় না আর তাই আশেপাশের বাজারে ঢেলে পাওয়া গেলেও পাহাড়পুরে চালানী মাছের নো এন্ট্রী। 

আর ছিল মিষ্টি, হ্যাঁ এখানে এই শীতের বেলায় একটা অনবদ্য গুড়ের রসগোল্লা পাওয়া যাচ্ছে, একটু ভারী, কলকাতার রসোগোল্লার চেয়ে ধারে আর ভারে, আলাদা অনেকটাই, চেকনাইও কম, কিন্তু মন ভরানো স্বাদ। আর ছিল স্থানীয় কারুর বাড়িতে পোষা গরুর দুধ কাটিয়ে তৈরী করা কালাকাঁদ। কলকাতার যে কোন নামী মিষ্টির দোকানের চেয়ে কোন অংশে সে কম যায় না, এত ভালো। মার্জিত মিষ্টি আর ওপরে অল্প হার্শেজ এর চকলেট সস ঢেলে খেলে একটা স্বর্গীয় মাত্রা যোগ হয়।  স্বভাবতই পাঠকরা অনুধাবন করছেন, চারবেলা শুধু প্রাণভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে অফুরন্ত খেয়েই গেছি। আর অরিন্দম মেপে খাওয়ানোয় বিশ্বাসী নয়, অতএব্ প্লেট সবসময়ই উপছে পড়ছে৷ আর আমি দুদিনই বেশ কয়েক মাইল করে হেঁটে, কখনো পাহাড়ে চড়ে, প্রাণপনে ক্যালরি ব্যল্যান্স করার উদগ্র প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি। 

এই হলো গিয়ে মোটামুটি দিকশূন্যপুর, থুড়ি পাহাড়পুরের গল্প। কি ভাবছেন? চলেই যাবেন একবার? বেশ এবার তাহলে কাজের ইনফর্মেশন গুলো দিয়ে দিই। 

পথনির্দেশঃ
পাহাড়পুর ট্রেনে যেতে চাইলে সবচেয়ে কাছের স্টেশন ইন্দ্রবিল। নামটা ভারী সুন্দর বটে তবে সমস্যা হল ছোট স্টেশন হওয়ার কারণে অনেক ট্রেন ওখানে থামে না। সেক্ষেত্রে ভরসা সাতাশ কিলোমিটার দূরের আদ্রা। অরিন্দমকে বলে রাখলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। রাস্তা ঝকঝকে, পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না। 

বাই রোড কলকাতা থেকে গেলে আপনাকে প্রথমে বাঁকুড়া আসতেই হবে। বাঁকুড়া আসার বেশ কয়েকটা উপায় আছে, ডানকুনি, আরামবাগ, বিষ্ণুপুর হয়ে বাঁকুড়া বা দূর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এসে দূর্গাপুর ঢোকার আগেই মুচিপাড়া মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে বরজোড়া, বেলিয়াতোড় হয়ে বাঁকুড়া। নয়ত বর্ধমান পর্যন্ত এসে পূর্ত ভবন থেকে বাঁদিকে ঘুরে দামোদর পেরিয়ে সোনামুখী, পাত্রসায়র, বেলিয়াতোড় হয়ে বাঁকুড়া৷ তিনটি রাস্তাই এখন ভালো আছে। আরামবাগ বিষ্ণুপুর হয়ে রাস্তাটা সবচেয়ে কম দূরত্ব কিন্তু পুরোটাই সিঙ্গল লেন আর ভিড়ভাড় হওয়ার দরুণ হরেদরে একই সময় লাগে।

বাঁকুড়া থেকে সোজা রাস্তা যেটি ছাতনার দিকে গেছে, সেই রাস্তা ধরে ছাতনা, আররা পেরিয়ে আসবে তালাজুড়ি। তালাজুড়ি থেকে বাঁ দিকে রাস্তায় ঘুরে কিলোমিটার দশেক গেলেই পাহাড়পুর ইকো রিসর্ট।  গুগল ম্যাপে সেট করে দিলে অনায়াসে পৌঁছে যাবেন। শুধু শেষের পাঁচশো মিটার গুগল ম্যাপ একটু গুলিয়ে ফেলে।  একটা লেফট টার্ণ নিয়ে ঢুকতে হয়, সেটা না দেখিয়ে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে তাতে বিশেষ সমস্যা নেই। স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবে।

বুকিং এর জন্য যোগাযোগ

PAHARPUR ECO RESORT

Arindam De : +919836131357

PAHARPUR_ECO_RESORT_PURULIA