Sir Daniel Mackinnon Hamilton and his bungalows at Gosaba Sundarban |
স্যর ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন, এক মহৎ জীবনের গল্প।
The history of Mackinnon Mackenzie & Co Ltd.
১৮৮০ সালে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে এক তরুণ স্কটল্যান্ড থেকে জাহাজে পাড়ি দিয়ে বম্বে (অধুনা মুম্বাই) বন্দরে এসে নামেন। নাম ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন। জন্ম ১৮৬০ সালের ৬ই ডিসেম্বর স্কটল্যান্ডের এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে। অল্প বয়সেই ভারতবর্ষে আসা পারিবারিক ব্যাবসার হাল ধরার জন্য। যে সে ব্যবসা নয়। খোদ ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি কোম্পানীর অন্যতম শেয়ারহোল্ডার ছিল ড্যানিয়েলের পরিবার। পৃথিবীর বহু জায়গায় শিপিং এজেন্ট হিসেবে রমরমা ব্যবসা করত ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি। ভারতে মুম্বাইয়ে অফিস ছাড়া ব্যবসা ছড়িয়ে ছিল কলকাতা, রেঙ্গুন, হংকং, সাংহাই, কোবে আর ইয়োকোহামাতে। সেই সময়ের দুটি বিখ্যাত শিপিং কোম্পানীর British India Steamship Company (BI) আর Peninsular and Oriental Steamship Company (P&O), শিপিং এজেন্ট ছিল ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি। ভারতবর্ষ থেকে লন্ডন যাত্রী এবং পণ্য পরিবহণের জন্য মূলতঃ এই দুটি কোম্পানীরই জাহাজ চলত। কলকাতা, শ্রীলঙ্কা এবং বম্বে থেকে P&O কোম্পানীর জাহাজ সুয়েজ আর কেপ হয়ে প্রতি ১৫ দিন অন্তর যেত লন্ডন। আর BI এর জাহাজ ভারত হয়ে মধ্যপ্রাচ্য, মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে নিয়মিত চলাচল করত। এই দুটি জাহাজ কোম্পানীরই এজেন্সি হাতে থাকার জন্য এবং ব্যবসা প্রায় একচেটিয়া হওয়ার জন্য ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি যথেষ্ট ফুলেফেঁপে উঠেছিল।
ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি কোম্পানীর যাত্রা শুরু হয়েছিল এই শহর কলকাতায়। একটু পিছিয়ে গিয়ে এই কোম্পানীর ইতিহাসে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
উইলিয়াম ম্যাকিনন, এই ভদ্রলোক হলেন যাঁকে নিয়ে আমাদের গল্প শুরু হয়েছিল, সেই তরুণ ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটনের পূর্বপুরুষ। জন্ম ১৮২৩ সালের ১৩ই মার্চ, স্কটল্যান্ডের ক্যাম্পবেলটাউনে। তরুণ বয়সে গ্লাসগোতে এসে প্রথমে একটি রেশমের গুদামে তারপর পর্তুগীজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিসে কাজ নিয়েছিলেন। এখানে কাজ করতে করতেই তাঁর মাথায় চিন্তা আসে ভারতে এসে ভাগ্যান্বেষণের। সেসময় বৃটিশ উপনিবেশ ভারতে জাঁকিয়ে বসছে, ব্যবসার প্রচুর সুযোগসুবিধা নিত্যনতুন খুলছে। বহু ইংরেজ সেসময় ভারতে আসছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর কাজে অথবা নিজের মতো করে ব্যবসায়ে ভাগ্যান্বেষণে। উইলিয়ামও ঠিক করেন তিনি আসবেন ভারতে। অবশেষে ১৮৪৭ সালে উইলিয়াম ম্যাকিনন পা রাখেন কলকাতায়।
তাঁর স্কুলের এক পুরোনো বন্ধু রবার্ট ম্যাকেঞ্জি তখন কলকাতায়। ম্যাকেঞ্জি এসেছিলেন তাঁর বন্ধুর কলকাতা পদার্পণের বেশ কয়েক বছর আগেই, ১৮৩৬ সালে। উইলিয়াম যখন কলকাতায় পা রাখলেন ততদিনে তাঁর বন্ধু ব্যবসাতে বেশ জমিয়ে বসেছেন। কিছু আমদানি, রপ্তানি ব্যবসার সাথে উপকূলীয় এলাকাতে স্টীমার সার্ভিস আর India General Steam Navigation Co নামের একটি ছোট জাহাজ কোম্পানীর শিপিং এজেন্সি নেওয়া ছিল।
উইলিয়াম সাহেব কলকাতায় আসার পরই দুই বন্ধুতে মিলে তৈরী করেন ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি কোম্পানী,। ১৮৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কোম্পানীর নথিভুক্তি হয়। ব্যবসা শুরু হয় মালপত্র আর ডাক পরিবহণের জন্য ভারতবর্ষ আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে জাহাজ চালানো দিয়ে।
এর কিছুদিন পর ১৮৫৬ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর তৈরী হয় Calcutta and Burma Steamship Navigation Company। এই কোম্পানীতে ম্যাকিননেরও বিনিয়োগ ছিল। তাঁরা কিছু পুরোনো জাহাজ কিনে চালাতে শুরু করেন। সেই সময় যেকোন শিপিং কম্পানীর জন্য ব্রিটিশ সরকারের থেকে RMS (Royal Mail Steamship) স্বীকৃতি পাওয়া ছিল ব্যবসায়িক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সরকারী পণ্য ও ডাক পরিবহণের কন্ট্র্যাক্ট আর তদোপরি নূন্যতম নিশ্চিত আয়ের সংস্থান,, এই দুয়ের হাতছানি যে কোন শিপিং কম্পানীর কাছেই অপ্রতিরোধ্য ছিল এবং সেকালে এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে রীতিমতো কঠিন প্রতিযোগিতা চলত। ম্যাকিননের প্রচেষ্টায় Calcutta and Burma Steamship Navigation Company এই RMS তকমা পেয়ে নিয়মিত জাহাজ চালাতে শুরু করে।
এর পরের কাহিনী শুধু উত্থানের। এর মধ্যেই ২৮ শে অক্টোবর ১৮৬২ সালে Calcutta and Burma Steamship Navigation Company এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় British India Steamship Navigation Company (BI). BI তৈরী হওয়ার পর ব্যাবসা বাড়ানোর জন্য তারা তৎকালীন আর এক বিখ্যত ফরাসী শিপিং কম্পানী Messageries Imperiales সঙ্গে হাত মেলায় শ্রীলঙ্কা আর পন্ডিচেরী বন্দর থেকে পারস্পারিক বন্দোবস্তের ভিত্তিতে যাত্রী এবং মাল বহনের জন্য।
ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি কম্পানী BI এর একমাত্র শিপিং এজেন্ট হিসেবে কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করত। এছাড়া ১৮৭১ সাল থেকে P&O কোম্পানীর শিপিং এজেন্সির কন্ট্র্যাক্টও ছিল এদের হাতে। এরপর আরো বড় একটা সুযোগ আসে ১৯১৪ সালে যখন BI এর সংযুক্তি হয় P&O এর সঙ্গে। সেই সময়ের হিসেবে দেখা যাচ্ছে এই দুই কম্পানীর হাতে মিলিত ভাবে ২০১ টি জাহাজ আর 1,146,767 GRT (Gross Registered Tons) পরিবহণ ক্ষমতা ছিল। এই দুই কোম্পানীর মিলনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জির আয়ও অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
Sir Daniel Mackinnon Hamilton - A magnanimous Life
এতো গেল কোম্পানীর ইতিহাস, এবার আমরা ফিরে আসি আমাদের আসল গল্পে যেটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছেন এই ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন। ১৮৮০ সালে বম্বেতে এসে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি কম্পানীতে যোগদানের বেশ কিছুকাল পর, বিংশ শতকের প্রথম ভাগে তিনি কলকাতার অফিসের কর্ণধার হয়ে আসেন। কর্মস্থল ছিল স্ট্র্যান্ড রোডে কম্পানীর কলকাতার সদর দপ্তরে।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। হ্যামিলটন সাহেব বিলিতি কম্পানীর সর্বোচ্চ পদাধীকারী হয়ে সেযুগের আর পাঁচজন উচ্চবিত্ত ইংরেজের মত বিলাস ব্যসনে আরামসে দিন কাটিয়ে দিতে পারতেন। আলিপুরের বাংলো, খিদমতগার, খানসামা, বেয়ারা, পরিবৃত হয়ে, সন্ধ্যায় উচ্চকোটির ক্লাবে গলফ খেলে, গ্রীষ্মের ছুটিতে সিমলা দার্জ্জিলিং ইত্যাদি করে শেষ বয়সে প্রভুত অর্থ নিয়ে দেশে ফিরে নিরুপদ্রবে অবসর জীবন কাটানোটাই তাঁর পক্ষে দস্তুর ছিল। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ অন্যরকম হন, বাঁধাধরা পথে তাঁরা হাঁটেন না। নিষ্কন্টক আত্মকেন্দ্রীক জীবনের হাতছানি এড়িয়ে এঁরা অজানায় ঝাঁপ দেন। বৃহত্তর স্বার্থে মানুষের জন্য কিছু করার অদম্য তাড়না তাঁদের মধ্যে চলতে থাকে। ইতিহাসের পট পরিবর্তনে এই মানুষগুলোই হন অনুঘটক। ড্যানিয়েল হ্যামিলটন ছিলেন এমনই একজন ব্যতিক্রমী মানুষ।
সালটা হল ১৯০৩। হ্যামিলটন সাহেব সুন্দরবনের অধুনা গোসাবা ব্লকে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে একলপ্তে ৯০০০ একর জমি কিনে নিলেন। এর মধ্যে গোসাবা ছাড়াও, রাঙাবেলিয়া, সাতজেলিয়া প্রভৃতি দ্বীপগুলিও ছিল। সেই সময় সুন্দরবনের ওইসব এলাকাগুলি দুর্গম আর বিপদ সংকুল, আক্ষরিক অর্থেই জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘ। তার ওপর ছিল জলদস্যুদের উপদ্রব। নোনা জলের বানে প্রতিবছর ভেসে যেত পুরো এলাকা, চাষবাস তো দূরঅস্ত, মনুষ্য বসতির জন্য সম্পূর্ণ প্রতিকুল পরিবেশ। সেই সময় তিনি নিজেই একটি জার্নালে লিখেছিলেন,
“In the Sunderbans of Bengal is a block of land which is now the home of the tiger and the deer, the wild boar and the crocodile. Two or three hundred years ago, I am told, it was the home of men, and I understand that the remains of old buildings and roads may still be seen. I am applying to the Government of Bengal for that land on which with the help of the bhadralok, the rayat and the Government of India, I shall create a zamindary of 30,000 biggahs or 10,000 acres, and hand it over to the Government of Bengal free of cost.”
সেই মত কর্মকান্ড শুরু হয়ে গিয়েছিল। হ্যামিলটন সাহেব কলকাতা থেকে লোকলস্কর নিয়ে গিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। জঙ্গল কেটে চাষের জমি তৈরী করা, মাটির উঁচু বাঁধ তৈরী করে নোনাজলের বন্যা থেকে সেই জমিকে রক্ষা করার কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। হ্যামিলটন সাহেব এই এলাকায় থেকে নিজেই পুরো কাজের দেখভাল করতেন।
পুরো জমি চাষযোগ্য হলে তিনি এলাকাটিকে প্রায় ২৩৬ টি লটে ভাগ করে জনসাধারণকে লিজ দেওয়া শুরু করেন চাষ আবাদের জন্য। লোকবসতি তৈরী করার জন্য বাংলা ছাড়াও প্রতিবেশী উড়িষ্যা এবং বিহার থেকেও লোক এনেছিলেন হ্যামিলটন সাহেব। সরাসরি চুক্তি করা হয় উৎসাহী চাষীদের সঙ্গে। প্রত্যেককে ২৫ বিঘা করে এবং তার স্ত্রীর নামে আরো ২০ বিঘা, মানে পরিবারপিছু মোট ৪৫ বিঘা করে জমি লীজ দেওয়া হয়। চাষ আবাদ শুরু হলে মনুষ্যবসতি শুরু হবে আর ফসল বেচে জমির লিজ হোল্ডাররা ক্রমশঃ স্বনির্ভর হয়ে উঠবে এই ছিল মূল লক্ষ্য। এপর্যন্ত ঠিক আছে, ব্রিটিশ ভারতে জমিদারী প্রথা কিছু নতুন ছিল না। তফাৎ হল আদতে জমিদারি মডেল হলেও সেটিকে একটি আদর্শ ওয়েলফেয়ার এস্টেট হিসেবে গড়ে তোলা ছিল হ্যামিলটনের স্বপ্ন। কো-অপারেটিভ মুভমেন্ট বলতে আমরা যা বুঝি সেটা হ্যামিলটন সাহেব বিংশ শতকের শুরুতেই দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই গোসাবায় ১৫ জন সদস্য নিয়ে তৈরী হয় ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি। সোসাইটির প্রথম মূলধন ৫০০ টাকা, হ্যমিলটন সাহেব নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলেন। এটি ছিল প্রধান সংস্থা, এবং এর পর এটিকে ভিত্তি করে আরো ছোট ছোট সেলফ হেল্প গ্রূপ তৈরী করে ক্ষুদ্র ঋণের সুবিধা যাতে সকলে পেতে পারে তার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সে সময় ব্যাঙ্কিং সুবিধা গ্রামাঞ্চলে ছিল না, গোসাবার মত জায়গাতে তো নয়ই। তখন গ্রামে গ্রামে মহাজনদের রমরমা। জমি বাড়ি বন্ধক রেখে অস্বাভাবিক হারের সুদে টাকা ধার নিয়ে মানুষ আজীবনের মতো এদের জালে জড়িয়ে পড়ত। আসল তো দুরের কথা, সুদের টাকাও শোধ করা খাতকদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ত। এরপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত যদি কোন বছর খরা, অতিবৃষ্টি বা বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিত, তাহলে সব হারিয়ে এরা ক্রীতদাসে পরিণত হত। এই ভয়ংকর মহাজনদের সম্মন্ধে হ্যামিলটন সাহেব ভালোই অবগত ছিলেন। তিনি বলতেন মহাজনরা হল আদতে Hookworms এর মতো। এই মহাজনদের এবং আড়কাঠিদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যই কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি তৈরি আর তার প্রসারে প্রচুর অর্থ এবং সময় ব্যয় করেছিলেন তিনি।
এরপর গোসাবায় তাঁর কর্মকান্ড তরতর করে এগিয়ে চলে। উন্নয়নের তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ। ১৯১৮ সালে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বন্টনের জন্য তৈরী হয় Consumers' Cooperative Society, এছাড়া ১৯১৯ সালে একটি মডেল ফার্ম তৈরী করা হয় যেখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ধান, সবজি, বিভিন্ন স্থানীয় ফল্মুল ইত্যাদি চাষের পদ্ধতি আর ফলন বাড়ানোর উপায় নিয়ে কাজ চলত। এলাকায় উৎপন্ন ধানের সুষ্ঠ বিক্রি আর উৎপাদনকারীরা যাতে ন্যায্য দাম পান সেজন্য ১৯২৩ সালে তৈরী হয় Paddy Sales Society। এলাকার সমস্ত উৎপন্ন ধান জমা করা হত একটি কেন্দ্রীয় গোলায়। সেখান থেকে উপযুক্ত সময় বুঝে খোলা বাজারে ধান বিক্রি করা হত যাতে দাম ভালো পাওয়া যায় আর সরাসরি সেই লাভের শরিক হত সমস্ত কৃষকরা। তার পরের বছর আত্মপ্রকাশ করে গোসাবা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক। এলাকার কমবেশি ১৯টি ক্রেডিট সোসাইটির ঋণের প্রয়োজন মেটাতো এই ব্যাঙ্ক।
যামিনী রাইস মিল তৈরী হয় ১৯২৭ সালে। এলাকায়্ উৎপন্ন ধান থেকে চাল যাতে স্বয়মনির্ভর ভাবে এলাকাতেই তৈরী করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। ১৯৩৪ সালে সুসংহত গ্রামীণ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের রূপরেখা তৈরী এবং তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠে Rural Reconstruction Institute। তার দুবছর পরে গোসাবাতে হ্যামিলটন সাহেব চালু হয় বিনিময়ের জন্য নিজস্ব এক টাকার নোট। এতে ছাপা থাকত এই লাইনটি “Sir Daniel Mackinnon Hamilton promises to pay the Bearer, on demand, at the Co-operative Bhundar, in exchange for value received, One Rupee’s Worth of rice, cloth, oil or other goods (sic).” (নিচের ছবি দ্রষ্টব্য)
এই কর্মকান্ড চলাকালীন হ্যামিলটন সাহেবের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই কর্মকান্ড নিয়ে তাঁর বহু পত্র বিনিময় হয়েছে। হ্যামিলটনের হাতে সুন্দরবনের গোসাবা যে সময় গড়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথও সেই সময়ে বীরভূমে পল্লী উন্নয়ন এবং আশ্রমিক শিক্ষার আদর্শ নিয়ে গড়ে তুলছেন শান্তিনিকেতনকে। ফলতঃ দুজনারই আগ্রহ ছিল পরস্পরের মতাদর্শ এবং কাজের প্রতি। সরকারি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভরসা ছিলনা তার প্রমাণ পাওয়া যায় হ্যামিলটনকে লেখা কবিগুরুর চিঠির এই লাইনটা। তিনি লিখলেন,
‘I have not much faith in politicians when the problem is vast needing a complete vision of the future of a country like India entangled in difficulties that are enormous. These specialists have the habit of isolating politics from the large context of national life and the psychology of the people and of the period. They put all their emphasis upon law and order, something which is external and superficial and ignore the vital needs of the spirit of the nation…
গোসাবা প্রোজেক্টের সব কাজ শেষ হতে হতে প্রায় ১৯৩০ সাল হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৪ সালে শুরু করে একটু একটু করে তাঁর স্বপ্নকে গড়ে তোলেন ড্যানিয়েল হ্যামিলটন। অবশেষে ১৯৩০ সালে তিনি কবিগুরু এবং মহাত্মা গান্ধী দুজনকেই গোসাবাতে আমন্ত্রণ জানান তাঁর কর্মকান্ডকে স্বচক্ষে দেখার জন্য।
গান্ধীজী নিজে আসতে পারেননি, কিন্তু তাঁর ব্যাক্তিগত সহায়ক মহাদেব দেশাইকে পাঠিয়েছিলেন গোসাবায়। দেশাই গোসাবায় এসেছিলেন ১৯৩৫ সালে। সাতদিন এখানে থেকে, নিজের চোখে সব কিছু দেখে ফিরে গিয়ে তিনি সাপ্তাহিক 'হরিজন' পত্রিকায় চার খন্ডের রিপোর্ট দিয়েছিলেন। সেই ব্যাপারে আবার ফিরে আসছি।
Rabindranath Tagore's visit at Gosaba and stay at Beckon Bungalow
রবীন্দ্রনাথের পদধুলিতে ধন্য হয়েছিল গোসাবার মাটি। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে কবিগুরু ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের আতিথ্য গ্রহণ করেন। সে বছরের শেষ দুটি দিন ৩০ এবং ৩১শে ডিসেম্বর অশীতিপর রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছিলেন বেকন বাংলোতে। একাত্তর বছর বয়সেও কবিগুরু ছুটে গিয়েছিলেন নতুন কিছু শেখার তাগিদে। গোসাবায় কবিগুরুর দুদিনের আবাস সেই কাঠের তৈরী বেকন বাংলো এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।
আগেই বলেছি গান্ধীজীর সচিব মহাদেব দেশাই এসেছিলেন ১৯৩৫ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী। তিনি পুরো কর্মকান্ড এক সপ্তাহ ধরে গভীর উৎসাহের সঙ্গে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাঁর নিজের লেখা রিপোর্ট থেকেই বোঝা যায় ড্যানিয়েল হ্যামিলটন এবং তাঁর কর্মকান্ড সম্মন্ধে তিনি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর নিজের জবানীতে হ্যামিলটন সাহেবের সম্পর্কে লিখেছেন,
"A man of lofty idealism, everything he has done has had some noble conception at its back"
এছাড়াও তাঁর জবানী থেকে বিশেষ কিছু অংশ তুলে দিলাম। গোসাবা প্রোজেক্টের বেশ কিছু দিক তাঁকে বিস্মিত আর মুগ্ধ করেছিল, তারই প্রকাশ নিচের ছত্রগুলিতে।
What is remarkable is the fact that in a population of 10,000 there has been no case, criminal or civil, that has ever gone to the law courts. As I examined the records, I came across the proceedings – elaborate enough – of an intricate partition case that the Panchayats had tried and decided to the satisfaction of the parties. No wonder a Calcutta Barrister said that the Panchayats in Gosaba administered justice more expeditiously and with more fairness and equity than law courts and without any expense whatsoever.
সত্যই সে সময় গোসাবায় মানুষের মধ্যে বিবাদ বিস্মবাদ প্রায় ছিলই না এবং থাকলেও তা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সাপেক্ষেই নিষ্পত্তি হত। থানা, পুলিশ, কোর্ট, কাছারী এসবের প্রয়োজন পড়ত না।
নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোস্যাইটির কর্মকান্ড মহাদেব দেশাই খুব কাছ থেকে খতিয়ে দেখেছিলেন, কথা বলেছিলেন সদস্যদের সঙ্গে, পরীক্ষা করে দেখেছিলেন ঋণদান এবং ঋণশোধ সম্পর্কিত যাবতীয় কাগজপত্র। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা ওনার নিজের লেখা থেকেই তুলে দিলাম।
I visited several villages on the Estate and talked to people, questioning and cross questioning them in detail, and examined their records also. I found that not only were the loans being repaid fairly regularly, but that they were being appropriated for the purpose for which they were borrowed. I examined the records of the village Panchayats and was agreeably surprised at the orderliness, precision and cleanliness with which they were kept.
এই ছিলেন ড্যানিয়েল হ্যামিলটন। যে গোসাবা জল, জঙ্গলপূর্ণ মানুষের অগম্য বাদাবনের অংশ ব্যতীত কিছুই ছিল না, কর্মকান্ড শুরু হওয়ার ৩০ বছরের মধ্যে গোসাবা প্রায় ১০,০০০ বাসিন্দার এক সমৃদ্ধ এবং স্বয়ংসম্পুর্ণ জনপদ হয়ে গড়ে উঠেছিল। গোসাবার কর্মকান্ডে বরাবরিই ওতঃপ্রত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। প্রতি বছর শীতকালে নিয়ম করে তিনি গোসাবায় এসে থাকতেন। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত সেগুন কাঠের বাংলোটি আজও গোসাবায় দাঁড়িতে আছে। শেষ জীবনে হ্যামিলটন সাহেব স্কটল্যান্ডে তাঁর দেশে ফিরে যান। দেশে ফেরার অনতিকাল পরেই ১৯৩৯ সালের ৬ই ডিসেম্বর (যে তারিখ তাঁর জন্মদিনও বটে) তাঁর দেহান্ত হয়। যেসব বিদেশী ভারতবর্ষে এসে এই দেশটিকে আপন করে নিয়ে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন সেই তালিকায় স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন অবশ্যই ওপর দিকে থাকবেন আর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম চিরকাল স্মরণ করা হবে।
গোসাবা মডেল যে কতটা শক্ত ভিতের উপর তৈরী হয়েছিল তার অগ্নিপরীক্ষা হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৈন্যদের জন্য খাদ্য আর রসদ মজুতের দোহাই দিয়ে চার্চিলের ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছাকৃত জনবিরোধী নীতির কারণে বাংলার বুকে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ইতিহাসের পাতায় যেটা তেতাল্লিশের মন্বন্তর নামে কুখ্যাত। এই মন্বন্তরে অবিভিক্ত বাংলায় প্রায় ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় অনাহারে, অপুষ্টিতে আর রোগে ভুগে। এই দুঃসময়েও গোসাবা অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের খুব একটা প্রভাব পড়েনি। কো-অপারাটিভ সোস্যাইটির দৌলতে যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ ছিল। কো-অপারেটিভ সোসাইটির ইন্সপেক্টরের রিপোর্টে দেখা যায় সেই মন্বন্তরের বছরেও হ্যামিলটনের সোসাইটি লাভের মুখ দেখেছে।
উন্নতির শিখর ছোঁয়ার পরের কাহিনী শুধুই পতনের। কিভাবে তিল তিল করে গড়ে তোলা এক স্বপ্নের অপমৃত্যু হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ গোসাবা। স্যর ড্যানিয়েলের ভারত ত্যাগ আর দেহান্তের পর তাঁর এস্টেটের দ্বায়িত্ব বর্তায় তাঁর ভাইপো জেমস হ্যামিলটনের উপর। কিন্তু কার্যত এস্টেটের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ম্যানেজার সুধাংশু ভূষণ মজুমদারের হাতে। এই সময় থেকেই এস্টেটের অফিশিয়াল / ম্যানেজারদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে দুর্নীতি, চাষীদের ওপর অত্যাচার, বেআইনি ভাবে চাষজমির ভাড়া বাড়ানো, জমিদখল ইত্যাদি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। উল্টে চাষীরাও প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদেরও যথাসাধ্য দমন করার চেষ্টা হয় এস্টেটের পক্ষ থেকে। ম্যানেজারদের মদতে প্রজাদের উপর পুলিশি অত্যাচার আর ধরপাকড় শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই গা জোয়ারী, তার প্রতিবাদ আন্দোলন এই সব কিছুর মধ্যেই অনতিবিলম্বেই রাজনৈতিক রঙ লাগে। আগে যা কোনদিনও হয়নি, সেই লড়াই, ঝগড়া, মামলা মোকদ্দমাও পুরোদমে শুরু হয়ে যায়।
এভাবেই চলছিল, এর পর জমিদারিপ্রথার অবসান হয় ১৯৫৬ সালে। এস্টেটের দ্বায়িত্ব বর্তায় হ্যামিলটন চ্যারিটেবল ট্রাস্টের হাতে। এরপর তৎকালীন শাসক দল কংগ্রেস আর আর এস পির, পক্ষ থেকে চাষীদের মদত দেওয়া হয় ট্রাস্টের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য। জেমস হ্যামিলটন ট্রাস্টের দ্বায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ডামাডোল শুরু হওয়ার পর তাঁরও বিশেষ কিছু করার ছিল না, দেশীয় ম্যানেজাররাই তখন দাপিয়ে বেরাচ্ছে। এরপর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি যখন সিপিএম সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে, হ্যামিলটন চ্যারিটেবল ট্রাস্টের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। প্রচুর মামলা মোকদ্দমা আর টানাপোড়েন চলার পর নব্বই এর দশকের শেষ দিকে হ্যামিলটন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট একটি পাবলিক চ্যারিটেবল ট্রাস্ট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একটি ট্রাস্টী বোর্ড, যার প্রধান হলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার ডেপুটি কমিশনার, বর্তমানে সব কিছু দেখাশুনা করে। এর মধ্যে দুটি বাংলো, প্রাইমারী স্কুল আর একটি ডিসপেন্সারি ছাড়া আর বিশেষ কিছুই ট্রাস্টের অধীনে নেই এবং সেগুলোরও যে ঠিকমত দেখভাল হয় না সেটাও প্রকট।
হ্যামিলটন সাহেব তাঁর জীবৎকালে প্রায় ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে স্বপ্নকে তিলতিল করে গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরই কিছু লোকের চরম লোভ আর দূষিত রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির খেলায় শেষ হয়ে গেল। আজ গোসাবায় শুধু দুটি কাঠের বাংলো অতীতের গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার গোসাবা ভ্রমণঃ
গোসাবা সুন্দরবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গঞ্জ। নদী আর খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার হল গোসাবা। ফলে সবসময়ই স্থানীয় মানুষের ভিড়ে গমগম করে। তবে গোসাবা ঠিক ট্যুরিস্ট সার্কিটের মধ্যে পড়ে না। গোসাবায় নদীর উল্টোদিকেই গদখালি। কলকাতা এবং ক্যানিং এর সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ আছে। সুন্দরবনের ট্যুরিস্টরা সরাসরি গদখালি ঘাট থেকেই লঞ্চে ভেসে পড়েন। ওপাশে পাখিরালা আর সজনেখালি, সেখান থেকে পারমিট করিয়ে সুন্দরবনের গহনে ঢুকে যান।
ডিসেম্বরের এক রবিবারের শীতের সকালে একাই মোটরসাইকেলে বেরিয়ে পড়েছিলেম। কিছুদিন আগেই ড্যানিয়েল হ্যামিলটনকে নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশুনা করেছি, আগ্রহও জন্মেছে। গোসাবায় গিয়ে তাঁর এবং রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাংলোদুটি দেখে আসার ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়েছিল। বিধিবাম, সঙ্গীসাথী কেউ জুটলো না, অতএব কবিগুরুর একলা চলো রে গানটিকে স্মরণ করেই ক্যামেরা গুছিয়ে বাইকে চড়ে বসলাম।
কলকাতা থেকে গদখালী যাওয়ার দুটি রাস্তা। প্রথম অপশন ই এম বাইপাসে উঠে পরমা আইল্যান্ড থেকে পিসি চন্দ্র গার্ডেনের পাশ দিয়ে গিয়ে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে নেওয়া। অথবা বাইপাস ধরে গড়িয়া হয়ে নতুন ইএম বাইপাস ধরে সোজা বারুইপুর। সেখান থেকে ক্যানিং হয়ে গদখালি।
গুগল ম্যাপের হিসেবে আমার বাড়ির লোকেশন থেকে দুটো রাস্তাতেই দুরত্ব মোটামুটি কাছাকাছিই দেখাচ্ছে,বাসন্তী রোড ধরলে ৮১ কিমি আর বারুইপুর ক্যানিং রুটে মোটামুটি ৮৪ কিমি।
ভেবেচিন্তে প্রথম অপশনটাই নিলাম। বাসন্তী হাইওয়ে রাস্তাটা আমার অসম্ভব প্রিয়। কলকাতার ভিড়ভাড়, জ্যাম, ধুলো, ধোঁয়া কাটিয়ে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে বেরিয়ে প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তাটা একেবারে অনবদ্য। একটু এগোলেই দুপাশে সবুজ হামলে পড়ে। সিঙ্গল লেন রাস্তা হলেও কন্ডিশন চমৎকার আর ট্রাফিকের ভিড়ও কম। শুধু কিছু বিচ্ছিরি টাইপের বাঁক আছে আর বাসগুলো পাগলের মত চালায়। তাই একটু সাবধানে চালাতে হয়, ব্যস আর কোন সমস্যা নেই।
ধাপাতে বাসন্তী হাইওয়ে শুরু হওয়ার মুখেই একটা বড় বোর্ড আছে। লেখা আছে
“You are just 86 km away from the UNESCO world heritage site Sundarban”
এছাড়াও দুপাশে সোনাখালি, গদখালি, বাসন্তী আর ঝড়খালির দূরত্ব লেখা।
এই বোর্ডটা দেখলেই আমার মনে বেশ একটা উত্তেজনা হয়, নাকে যেন বাদাবনের গন্ধ ভেসে আসে, এই রাস্তার শেষেই সুন্দরবন, কথাটা ভাবতেই একটা রোমাঞ্চ লাগে। এ যেন এক মুক্তির ঠিকানা।
কালো চকচকে পিচঢালা রাস্তা, দুপাশে শুধু সবুজ, বাঁদিকে একটা খাল চলেছে রাস্তার সমান্তরালে, দৃশ্য খুব সুন্দর হলেও আমি জানি ওটা আদতে স্যুয়ারেজ ক্যানেল, কলকাতা শহরের সব দুষিত বর্জ্য বুকে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। জলের রঙ ঘন কৃষ্ণবর্ণ। খানিকটা এগোতেই বানতলার ট্যানারী কমপ্লেক্স ডানদিকে রেখে এগিয়ে গেলাম। এবার ট্র্যাফিক আরো পাতলা হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে শুধু কয়েকটা ঘিঞ্জি জনপদ,বানতলা, ভোজেরহাট, ঘটকপুকুর। মোড়গুলোতে বাস, লরি, সাইকেল, বাইক, ইঞ্জিন ভ্যান সব সরু রাস্তার ওপর জড়াজড়ি করে আছে, হর্ণের শব্দে কান পাতা দায়। কয়েক জায়গায় রাস্তার ওপর বাজার বসেছে, হাজার লোকের দমচাপা ভিড়। এই জায়গাগুলো কোনোমতে কাটিয়ে উঠতে পারলে বাকি রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। বাইক থাকার এটাই সুবিধা কাটিয়ে কুটিয়ে বেরিয়ে আসা যায়। গাড়ি হলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না।
মাঝখানে বড় জায়গা মালঞ্চ, এখানের মাছের পাইকারী বাজার বিখ্যাত। মালঞ্চ থেকেই বাঁদিকে রাস্তা কেটে গেছে টাকী হয়ে বসিরহাট আর হাসনাবাদ। আমি যাবো সোজা। এখানেই থেমে একটা মিষ্টির দোকানে কচুরি, আলুর তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম, কারণ বেলা হয়েছে আর এর পর সেই বাসন্তীর আগে পথে কিছু খাবার পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে ঘোর সংশয় আছে।
মালঞ্চ ছাড়াতেই রাস্তার দুপাশে দৃশ্যপট পাল্টালো, দুপাশেই দিগন্তবিস্তারী জলাভূমি, সকালের রোদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। এগুলো সব মাছের ভেড়ি, অগভীর জলে মাঝে মাঝে কাদার চর জেগে রয়েছে, সেখানে কোঁচ বক আর পানকৌড়িদের বিচরণ। দূরে মাঝেমধ্যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো চিমনির সারি, কয়েকটার মাথা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। এগুলো সব ইঁটভাঁটা। নদীর পলি পড়া এঁটেল মাটি সুলভ হওয়ার জন্য এই অঞ্চলে ইঁটভাঁটার রমরমা।
দেখতে দেখতে বাসন্তী পেরিয়ে গেলাম। এখান থেকে রাস্তা আবার দুভাগ হয়েছে, একটা চলে গেছে ঝড়খালি আর অন্যটা সোনাখালি হয়ে গদখালি। একদফা চা আর সিগারেটের জন্য এখানে পাঁচ মিনিটের ব্রেক বরাদ্দ করলাম। এরপর আর না থেমে সোজা গদখালির ঘাট। এবার রাস্তায় দেখলাম পিকনিক পার্টির বাস আর ট্রাকের ভিড় বাড়ছে, গাড়ীতে করে দল বেঁধে সুন্দরবনের পর্যটকরা চলেছেন। দেখতে দেখতে সোনাখালি এসে গেল, এখানের ঘাট থেকেও সুন্দরব দর্শনের লঞ্চ ছাড়ে। আমার গন্তব্য আরো এগিয়ে গদখালির ঘাট।
গদখালির ঘাটে পৌঁছে দেখি ভিড় গিজগিজ করছে। সরু রাস্তা যেটা ঘাটে গিয়ে শেষ হয়েছে তার দুপাশে শুধু ট্যুর অপারেটরদের অফিস, ভাতের হোটেল আর মিষ্টির দোকান। রাস্তার দুপাশে যেখানেই খোলা জায়গা আছে সেখানে পার্কিং এর রমরমা ব্যবসা। ট্যুরিস্ট বাস থেকে, ছোট গাড়ি, বাইক সব কিছু রাখার ব্যবস্থা আছে দক্ষিনার বিনিময়ে। তার উপর সুন্দরবন উৎসবের সেটা ছিল শেষ দিন, ফলে স্থানীয় মানুষদের ভিড়ও যথেষ্ট।
নদীর উল্টোপারেই গোসাবা। দেশী বোটে মোটরসাইকেল পার করে দেওয়ারও বন্দোবস্ত আছে কিন্তু আমি আর সে হ্যাপায় যাইনি। খুঁজে পেতে ঘাটের সামনেই একটি ভাতের হোটেলের সামনে বাইক পার্ক করে হেলমেট দোকানদারের জিম্মায় রেখে দিলাম। না এর জন্য পয়সা লাগেনি কিন্তু অলিখিত চুক্তি হল ফিরে এসে ওই হোটেলেই ভাত খেতে হবে। তাতে আমার অসুবিধা নেই, হিসেব করে দেখলাম, হাতে যা সময় আছে গোসাবা ঘুরে বেলা দুটোর মধ্যে এখানে ঢুকে যাব। সুতরাং লাঞ্চ এখানেই খেয়ে নেওয়া যাবে।
এবার এলাম ঘাটে। গদখালির মুল ঘাট থেকে সুন্দরবন বেড়ানোর লঞ্চ ছাড়ছে। দলে দলে পর্যটকরা উঠছেন। দেখলাম তার মধ্যে বেশ কিছু বিদেশী পর্যটকও আছেন। জানা গেল এই ঘাট থেকে গোসাবার বোট পাওয়া যাবে না, তার জন্য আগে একটা ঘাট আছে। পায়ে পায়ে চলে এলাম সেখানে, মুল ঘাট থেকে মাত্র দুতিন মিনিটের হাঁটাপথ। এই ঘাট তুলনায় ফাঁকা। শুধু কিছু স্থানীয় মানুষজন আছেন। অনেকেরই হাতেই বড় থলি, বস্তা ইত্যাদি রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে বাজার করে যে যার গ্রামে ফিরছেন। বোট সার্ভিস ১৫ থেকে ২০ মিনিট অন্তর অন্তর। এখানে লঞ্চ নেই, দুই সিলিন্ডারের ইঞ্জিন লাগানো দেশী নৌকা। পারানির কড়ি মাত্র পাঁচ টাকা, ওপারে গদখালির ঘাটে নেমে পয়সা দিতে হবে। আগের বোটটা একটু আগেই ছেড়ে গেছে, সুতরাং মিনিট পনেরো দাঁড়াতে হল। নদীর ধারে হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, কিন্তু রোদ চড়া, তাই শীতবোধ কম হচ্ছে। এখানে নদী যথেষ্ট চওড়া। নদীর বুক চিরে মাঝেমধ্যেই লঞ্চ চলে যাচ্ছে। কালো কালো ফালির মতো জেলেদের নৌকা ভাসছে। ওপারে বোঝা যাচ্ছে গোসাবার তটরেখা।
একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে ঘাটে। দূরে যখন ফেরী বোট দেখা গেল ঘাটে তখন গমগমে ভিড়। এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি নৌকা ভর্তি করে লোক আসছে এদিকে। ভারের চোটে জল প্রায় নৌকার গলুই ছোঁয় ছোঁয় অবস্থা। দেখে শহুরে লোকের একটু ভয় হওয়া স্বাভাবিক, একে আমি তো সাঁতার জানিনা, আর মাঝনদীতে নৌকা উল্টোলে আমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি কেউ আটকাতে পারবে না পরিষ্কার বুঝতে পারছি। কিন্তু স্থানীয়রা নির্বিকার, এটা ওঁদের রোজনামচা, তাই দিব্যি সবাই হুড়োহুড়ি করেই নৌকায় উঠে বসলেন। ছইহীন বড় নৌকা, আমি কোনমতে ব্যালান্স করে পিছনের দিকে গিয়ে গলুইতে হেলান দিয়ে বসে গেলাম।
প্রবল ভটভট শব্দ আর ডিজেলের কালো ধোঁয়া উড়িয়ে বোট ছাড়ল। গোসাবার ঘাট মোটামুটি দশ মিনিটের জার্ণি। এখানে নেমে পারানির কড়ি মিটিয়ে বাইরে এলাম। ঘাটের ঠিক বাইরেই বাজার। বেশ কিছু টোটো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার কোন ধারণা ছিল না বাংলোদুটি কোনদিকে আর ঠিক কতটা দূরে। সময় বাঁচানোর জন্য ভাবলাম একটা টোটো ভাড়া করে বলি দুটোই দেখিয়ে আবার ঘাটে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। এটা একটা ভুল ডিসিশন। টোটো পেলাম বটে, কিন্তু দেড়শো টাকার নিচে কেউ ঘুরিয়ে দেখাতে রাজি নয়। অগত্যা দেড়শোতেই রাজী হয়ে চড়ে বসলাম। পরে বুঝলাম আমি বোকা বনেছি, কেন সেটা এর পরে পড়লেই বুঝতে পারবেন।
টোটো চড়ার পর ঠিক দুমিনিটের মাথায় চালক বললেন এসে গেছে বেকন বাংলো। ঘাট থেকে মেরে কেটে ৫০০ মিটার এসেছি কিনা সন্দেহ, তার মধ্যেই রাস্তার বাঁ দিকে একটা বেশ বড় ফাঁকা মাঠ পড়ে আর তার একপ্রান্তেই বেকন বাংলো।
Beckon Bungalow where Rabindranath Tagore stayed
কাঠের খুঁটি আর প্ল্যাটফর্মের উপর ভর করে মাটির ফুট চারেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে বেকন বাংলো। এই হল সেই বাংলো যেখানে ১৯৩২ সালের ৩০ এবং ৩১শে ডিসেম্বর কবিগুরু থেকে গিয়েছিলেন। সম্পুর্ণ বাংলোটি বার্মা থেকে আনা সেগুনকাঠ দিয়ে বানানো। দুটি ঘর আর চারদিকে ঘিরে কাঠের রেলিঙ্ ওয়ালা বারান্দা। বাংলোর বাইরে ডান দিকে কবিগুরুর পুর্নাবয়ব মূর্তি। নিচে একটি ফলকে দেখা যাচ্ছে ২০০৩ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাংলোটির সংস্কার করা হয়। কিন্তু দেখলাম বাংলোটির বর্তমান অবস্থা বেশ করুণ, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট। দুটি ঘরই খোলা, ভিতরে আবর্জনার স্তুপ। লোকজন যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনভাবে চললে কিছুদিনেই এই বাংলোর অবস্থা কি হবে ভাবতেই ভয় হয়।
এখান থেকে দেখে শুনে ছবি তুলে বেরোলাম হ্যামিলটন বাংলোর উদ্দেশ্যে। এটি ছিল ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের নিজস্ব আবাস। প্রতি বছর শীতকালে তিনি এখানে এসে থাকতেন। এই বাংলো থেকেই পরিচালনা হত সমগ্র এস্টেটের কাজ।
বেকন বাংলো থেকে এর দুরত্ব মেরেকেটে দেড় কিলোমিটার, সুতরাং ঘাটে নেমে এই দুটো বাংলো পায়ে হেঁটেই অনায়াসে দেখে নেওয়া যায়, নিতান্ত বৃদ্ধ বা অশক্ত না হলে টোটো ভাড়া করার কোন প্রয়োজনই নেই। যাই হোক এবারে কপালে অর্থদন্ড লেখা আছে, খন্ডাবে কে, কিছু করার নেই।
যাওয়ার পথে নজরে পড়ল একটি নার্সারী স্কুলের একতলা বিল্ডিং। বাউন্ডারী ওয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। বিল্ডিং এর সামনে লেখা আছে স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিলটন ট্রাস্ট পরিচালিত অবৈতনিক স্কুল।
Hamilton's Bungalow where Sir Daniiel Hamilton used to stay
এখান থেকে অল্প দুরেই হ্যামিলটন বাংলো। সামনে একটি পুকুর, সবুজ সাদা রঙ করা বাংলোর ছায়া পড়ছে জলে। এটিও কংক্রীটের থাম ইংরেজীতে যাকে বলে Stilts তার উপর দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমনটি দেখেছি বেকন বাংলোর ক্ষেত্রে। আসলে এই সব এলাকা বরাবরই সাইক্লোনপ্রবণ। এই দুটি বাংলোই এমনভাবে বানানো যাতে ঝড় ঝাপ্টা সহ্য করে নিতে পারে। এমন ভাবে তৈরী, হাওয়া বাধা না পেয়ে পাস করে যায় সুতরাং ঝড়ের অভিঘাত কম পড়ে। পরপর দুটি দুর্যোগ, ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোন আর সাম্প্রতিক অতীতে আয়লা এবং ফণীর অভিঘাতেও বাংলো দুটির বিশেষ কোন ক্ষতি হয় নি।
এই বাংলোটি ছিমছাম, দেখে মনে হল বেকন বাংলোর তুলনায় এর রক্ষণাবেক্ষণ অনেক ভালো। বাংলোর ভিতরে হ্যামিলটন সাহেবের স্মৃতি বিজড়িত বেশ কিছু ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস, পারিবারিক ছবি ইত্যাদি আছে। এছাড়া তিনি সেই সময় পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের জন্য বিলেত থেকে ফিল্টারিং মেশিন আনিয়েছিলেন। তার অংশবিশেষও এখানে রাখা আছে।
আমার দুর্ভাগ্য সেদিন বাংলো বন্ধ ছিল। খোঁজাখুঁজি করেও খোলানোর লোক পাইনি, ফলে বাইরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট হতে হয়েছিল। ভিতরের জিনিসগুলির ছবি তুলব ভেবেছিলাম তা আর হয় নি।
মোটামুটি ঘন্টা খানেকের মধ্যে দুটো বাংলো দেখা শেষ করে আবার ঘাটে ফিরলাম। হ্যামিলটন বাংলো খোলা থাকলে ভিতরের জিনিসগুলি খুঁটিয়ে দেখতে আর একটু বেশী সময় লাগতো।
গদখালি ফিরে ভাতের হোটেলে জমিয়ে গরম গরম ভাত, ডাল তরকারি আর মুরগীর ঝোল খেয়ে সাড়ে তিনটের মধ্যে ফেরার রাস্তা ধরেছিলাম। এবার আর বাসন্তী হাইওয়ে ধরিনি। একটু বৈচিত্র দরকার ভেবে, ক্যানিং, বারুইপুর হয়ে ফিরেছিলাম। রাস্তা ভালো, শুধু ক্যানিং, বারুইপুর রাস্তায় অসংখ্য হাম্প আছে যেটা রীতিমতো বিরক্তিকর। এছাড়া ফিরতে কোন সমস্যা হয়নি।
কিভাবে যাবেনঃ
কলকাতা থেকে বাসন্তী হয়ে গদখালি বাস সার্ভিস আছে। অথবা শেয়ালদা সাউথ সেকশনের ট্রেন ধরে ক্যানিং পর্যন্ত এসে এখান থেকে বাসে বা শেয়ারের ম্যাজিক গাড়িতে চলে আসুন গদখালি। এখান থেকে প্রতি পনেরো, বিশ মিনিট অন্তর ছাড়ছে গোসাবা যাওয়ার ফেরী। গাড়িতে বা মোটরসাইকেলে এলে, গদখালির ঘাটে পার্কিং এর ব্যাবস্থা পাবেন। এখানে গাড়ী বা বাইক রেখে ফেরীতে পার হয়ে গোসাবা।
কি খাবেনঃ
গোসাবা ঘাটে খাবার হোটেল আছে আবার গদখালির ঘাটে যে কোন ভাতের হোটেলে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে পারেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি আসার রাস্তায় খাওয়ার অপশন খুবই কম। ঘটকপুকুর বা মালঞ্চতে কিছু খাবার দোকান পাবেন। সেই মতো প্ল্যান করবেন। মিনারেল ওয়াটার সব জায়গাতেই পাওয়া যাবে, অসুবিধে নেই।
পরিশিষ্টঃ
এক দিনের ট্রিপে অনায়াসে এই ঐতিহ্য আর ইতিহাস বিজড়িত বাংলো দুটিকে দেখে আসতে পারেন। সজনেখালী হয়ে সুন্দরবন বেড়াতে গেলে, টুক করে একটু সময় বার করে গোসাবায় নেমে পায়ে হেঁটেই ঘুরে নিতে পারেন এই দুই বাংলো।