Samshernagar and Jhingekhali Forest Range:Sundarban
মনটা পালাই পালাই করছিল বহুদিন ধরেই কিন্তু নানারকম চাপে ব্যাপারটা আর হয়েই উঠছিলনা। মানে এবারের সুন্দরবন যাত্রাটা। সুন্দরবন আমি গেছি বহুবারই, জলে জঙ্গলে বাদাবনে ঘোরাঘুরি কম হয় নি, কিন্তু এবারের আকর্ষণ ছিলো কিছুটা অন্য।সজনেখালি, সুধন্যখালি, দোবাঁকির চেনা পথ ছেড়ে এবার উত্তর চব্বিশ পরগণার বাংলাদেশ ঘেঁষা অচেনা জঙ্গলের স্বাদ নেওয়া। জঙ্গল এখানে তুলনামুলক ভাবে অনাঘ্রাত, সাধারণ সার্কিটগুলোর মতো এখনো অত ট্যুরিস্টলাঞ্ছিত নয়।
আমার এই দিকের জঙ্গলের প্রেমে পড়া ধীমানের হাত ধরে, ফেসবুকে যে আছে ‘সুন্দরী সুন্দরবন’ নামে। ধীমান এই এলাকারই ছেলে।বাড়ি হেমনগর কোস্টাল থানার পাটঘরা গ্রামে। সুন্দরবনকে ও নিজের হাতের তালুর মতই চেনে। ধীমানের ফেসবুকের দেওয়ালে অসংখ্য মনকাড়া ছবি দেখেই সুন্দরবনের এই অঞ্চলটার সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠা। ওর প্রোফাইলেই আমার দেখা শুরু প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের জীবন্ত জলছবি। বাদাবন,বন্যপ্রাণ আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষগুলির জীবনের গল্প উঠে আসে ধীমানের ক্যামেরায় আর লেখনীতে। সর্দারপাড়া ফেরিঘাট, কাটোয়াঝুরি আর ঝিঙেখালির জঙ্গল, আদিবাসিপল্লি, গ্রামজীবনের রোজনামচা, ভাটিয়ালী গান আর মোরগলড়াই এর কাহিনী এসেছে ফিরে ফিরে।ক্যামেরার মুন্সিয়ানা তো আছেই এছাড়া ধীমানের লেখার হাতটিও ভারী মিষ্টি, এক অনাবিল সরলতা আর বাদাবনের সোঁদা গন্ধ মাখানো থাকে তাতে।
এই লেখা আর ছবির টানেই যাওয়ার ইচ্ছেটা তৈরী হচ্ছিল, ধীমানও বহুবারই বলেছে চলে আসার জন্য, ইচ্ছে ও নিজে সঙ্গে করে আমাকে সুন্দরবন চেনাবে। এরপর যখন ও জানালো ওর স্বপ্নের বাগান বাড়ি ‘প্রসূন’ প্রস্তুতির পথে তখন গিয়ে পৌঁছানটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আমি দেখেছি আমার জীবনে প্ল্যান প্রোগ্রাম করে বিশেষ কিছু কোন দিনই করে দেখাতে পারিনি, ওই হুট করে যকে বলে ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ গোছের ব্যাপার না হলে আমার আর ঘর ছেড়ে বেরনো হয়ে ওঠে না। সুতরাং এবারো তাই, বন্ধু সুমিত বলল যাবে আর প্রায় একদিনের নোটিসে বেরিয়ে পড়া। সুমিতের মতলব অন্য, সে ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার, সে চলেছে পাখপাখালির খোঁজে, সঙ্গে মহার্ঘ্য ক্যামেরা আর তার সাথে হাউইটজার কামানের মতো দেখতে লেন্স।সামশেরনগরের নদীর আশেপাশে নাকি পাখির মেলা বসে।সেগুলিকে ক্যামেরাবন্দি করা সুমিতের লক্ষ্য।আমার এই ভুতটা অত মাথায় চাপেনি, আমি চলেছি গ্রাম আর তার মানুষগুলোকে দেখতে। হাতে সময় মোটে একদিন, মানে পুরো চব্বিশ ঘন্টাও নয় কিন্ত তাই সই, যেতে তো হবেই।
বাইকবাহনে যাত্রা শুরু, ইএম বাইপাস থেকে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে ঘটকপুকুর, মিনাখাঁ হয়ে সোজা মালঞ্চ। সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে ইছামতি নদীর তীরে টাকী ছুঁয়ে হাসনাবাদ।এদিন আকাশের মুখ সকাল থেকেই গোমড়া।আগের দিনই ঝকঝকে রোদ ছিল আর শেষ জানুয়ারীর ঠান্ডার আমেজ।কিন্তু এদিন হঠাৎ পুরো উলটো, সকাল থেকেই মেঘের দাপট, বাসন্তী রোডে উঠতেই শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি। কিন্তু কিছু করার নেই, বেরিয়ে যখন পড়েছি। সুমিতের কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগটা শুধু সামলে রাখার দায়। শহর ছাড়িয়ে একটু এগোতেই দুপাশে সবুজের বন্যা, কখনও বা দিগন্ত বিস্তৃত ভেড়ি, রাস্তার দুপাশে গাছের চাঁদোয়া। মাঝে মাঝে ছোট ছোট জনপদ, বাজার পেরিয়ে যাচ্ছি।কিছুক্ষনের মধ্যেই টাকীকে পাশে ফেলে হাসনাবাদ, এখান থেকে নদীর ওপর ফেরি পেরিয়ে চলে যাব উল্টো দিকে পারহাসনাবাদ।সেখান থেকে আবার হাসনাবাদ হিঙ্গলগঞ্জ রোড ধরে হিঙ্গলগঞ্জ পার করে সোজা লেবুখালি। সেখানে দ্বিতীয় বারের মতো ফেরি পার।ওপারে দুলদুলি হেমনগর রোড ধরে যোগেশগঞ্জ বাজার।সেখান থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে সর্দারপাড়া ফেরিঘাটের দিকে কিছুটা গেলেই পাটঘরা গ্রাম, আমাদের গন্তব্য।
কিছুটা ভিজে আর বেশ কিছু কাদা মেখে হাসনাবাদের ঘাটে পৌঁছে খোঁজ করলাম বার্জের, মোটরসাইকেল নিয়ে পার হতে হবে।কিন্ত কোথায় বার্জ, সেতো উল্টো দিকের ঘাটে ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে দাঁড়িয়ে, এপারে আসার নামই নেই আর আমরাও দাঁড়িয়ে আছি। মধ্যে তিনটে সিগারেট শেষ, সুমিত বোর হয়ে ব্যাগ থেকে ওর গোদা ক্যামেরা বের করে নদীর তীরে কাদায় চরে বেড়ানো পাখির ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। দেখাদেখি হাম কিসিসে কম নেহি বলে আমিও আমার পুঁচকে ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলতে লাগলাম।কাদা ঘেঁটে বেড়ানো পাখিগুলোর একটা নাকি ‘কমন স্যান্ডপাইপার’ আর অন্য লম্বা ঠ্যাংওয়ালা পাখিটাকে বলে ‘লং টোড স্টিন্ট’। এসব সুমিতের থেকে ঝাড়া বিদ্যে, এ ব্যাপারে আমার নিজের ফান্ডা শুন্য। আমার তো একটাকে দেখে সেই টেনিদার বলা কুরুবকের মতো লাগলো, আর অন্যটা নিশ্চই কাদাখোঁচা।সেই ছবিগুলোই পোস্টিয়ে দিলাম।
Hasnabad Ferry Ghat |
Long Toed Stint, Samshernagar, Sundarban :Photo Courtsey - Sumit Biswas |
কিন্তু দুঃসংবাদটা শুনলাম একটু পরেই, বার্জ নাকি ওপারে যথেষ্ট সংখ্যায় গাড়ি না পেলে এপাশে ভিড়বে না, তাতে নাকি তার লস, আর কখন যে সে ভর্তি হবে সে বলা ভগবানেরও অসাধ্য।অতএব বিকল্প কি না দেশী নৌকায় বাইক পার। গেলাম অন্য ঘাটে, কিন্তু সেখানে ব্যাবস্থাপনা দেখে চক্ষু চড়কগাছ।কংক্রিটের ভাঙ্গা ঘাট ধাপে ধাপে নেমে গেছে, ভাটার টানে নদীর জল অনেকটা নীচে, আর নৌকার ডগাটা শুধু ঠেকে আছে ঘাটের ধাপের সঙ্গে।এর মধ্যেই প্রায় ট্র্যাপিজের খেলা দেখিয়ে হ্যান্ডেলবার ধরে নিজেকে এবং মোটরসাইকেলকে ব্যালান্স করে নৌকায় নামতে হবে। একজন লোক আছে শুধু পিছন থেকে বাইকটাকে ধরে রাখার জন্য, কিন্তু নামাতে গিয়ে হড়কে একটু বেসামাল হলেই হয় বাইক সুদ্ধু জলে অথবা ঘাটের কংক্রিটের ধাপে লেগে হাড়গোড় ভাঙ্গবে, বাইকেরও বারোটা বাজবে।আবার গোদের ওপর বিষোঁড়ার মতো বৃষ্টির জন্য ঘাটের ধাপগুলো পিছল। যাই হোক হৃৎপিণ্ড প্রায় মুখে এনে, দুবার হড়কে, প্রায় ফেলে দিতে দিতে মাঝিদের থেকে যথেচ্ছ ঝাড় খেয়ে নিজেকে আর বাইককে তো কোনরকমে নামালাম। কিন্তু ওপারে গিয়ে আবার রিপিট টেলিকাস্ট, বাইক ঘাটে তুলতে গিয়ে। এতেও মুক্তি নেই, ঘাট থেকে ডাঙ্গায় উঠতে অনেক ধাপ খাড়াই সিঁড়ি চড়তে হয়। সিড়ির মাঝখানে একটা সরু কংক্রিটের র্যাম্প করা আছে, ঠিক বাইকের চাকার মাপে, সেখানে বাইকটাকে সোজা করে ধরে রেখে, ইঞ্জিন চালিয়ে গিয়ারে ফেলে ধীরে ধীরে ওঠাতে হয় আর নিজেকে পাশে পাশে হ্যান্ডেলবার ধরে ব্যালান্স করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে।সে এক বিষম কঠিন ব্যাপার। বিশদে আর না গিয়ে বলছি, লেবুখালির জেটিতেও বার্জ পাইনি অতএব একই ঘটনা ঘটেছিল।
Crossing on a country boat - Hasnabad Ferry Ghat |
এই দুটো ঘাট পেরোতেই যা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তা ছাড়া বাকি জার্নিটা ভারী সুন্দর ছিল, ভীষণ আনন্দ করে গেছি চারপাশ দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে। বৃষ্টিটাও শেষের দিকে ধরে গিয়েছিলো।যোগেশগঞ্জ বাজারে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় দেড়টা।
সেখান থেকে আবার ডানদিকে যে রাস্তা চলে গেছে সর্দারপাড়া ফেরিঘাট সেই রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়েই ছবির মতো গ্রাম পাটঘরা।সেখানেই ধীমানের সাধের বাগানবাড়ী “প্রসূণ”।সেটিই ছিলো আমাদের একরাতের আস্তানা।
গ্রামটি একবার দেখলেই মনে ধরার মতো। ধীমান জায়গাটি বেছেছে দিব্যি।পাকা রাস্তা থেকে নেমে ইঁটবিছানো পথ চলে গিয়েছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে। দুপাশে মাটির বাড়ি, খড়ের চালা,বেড়ার ধারে ফুলের গাছ, নিকোন উঠোন, সেখানেই বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি, মেয়েরা সব ঘরকন্নার কাজে ব্যাস্ত, দড়িতে শুকোচ্ছে রংবেরঙ্গের শাড়ী,জামাকাপড়। কোথাও একধারে মাটির চুলোতে হাঁড়ি চড়েছে, ভেসে আসছে রান্নার সুবাস,আঙিনার এককোণে উপছে পড়া ধানের মরাই, আবার কোথাও চলছে মাঠ থেকে সদ্য কেটে আনা ধান ঝাড়াই, পুরুষ মহিলা সবাই হাত লাগিয়েছে সমান তালে।সোনারঙ্গা খড় কেটে গোড়া বেঁধে চলছে নতুন করে ঘর ছাওয়ার কাজ।গোয়ালে গরুরাও ভাগ পেয়েছে খড়ের, জাবর কাটছে তারা।ছোট ছোট পুকুরে হাঁসের দল। এক্কেবারে যেন জলরঙে আঁকা ছবি। তবে দেখে বোঝা যায় প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও গ্রামটি বেশ বর্ধিষ্ণূ।প্রায় প্রতিটি মাটির বাড়ীর খড়ের চালে উঁকি মারছে ডিশ অ্যান্টেনা।ইলেকট্রিসিটির সমস্যা নেই,রাত্রে দেখেছিলাম প্রায় সব বাড়ীর জানলা দিয়েই এলইডি বাল্বের আলোর ছটা।
Patghara Village |
A small kid comes out to play Patghara Village |
সর্দারপাড়া ফেরীঘাট হলো এই অঞ্চলের এক গুরুত্বপুর্ণ জায়গা। নদীমাতৃক সুন্দরবনের যাতায়াত, পরিবহন সবই কিন্তু নদী বেয়ে, এখানে বোটই ভরসা মানে লাইফলাইন যাকে বলে। সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা বহুক্ষেত্রেই অপ্রতুল এবং সময়সাপেক্ষ। মোটরসাইকেলে আসার সময়ই আমরা কিছুটা টের পেয়েছি। যোগেশগঞ্জ বাজারের প্রায় সব মালপত্রই নৌকা চে্পে আসে ধামাখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, ক্যানিং বা আরও বহু দুরদুর জায়গা থেকে।সর্দারপাড়া ঘাটে তাই দিনভর ব্যাস্ততা আর হাঁকাহাঁকি, ঠিক যেন আমাদের বড়বাজার। শুধু তফাৎ হলো লরীর বদলে বোট থেকে মাল বোঝাই হচ্ছে বা খালাস হচ্ছে, লোক যাতায়াতও চলছে, বাসের মতোই ঠেসে লোক উঠছে বোটে।
A busy day at Sardarpara Ferry Ghat |
এবার একটা ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার আছে, এই সর্দারপাড়া নামটা নিয়েই। ধীমানের কাছ থেকেই খানিকটা শোনা। কিছু্টা আশ্চর্যজনক ভাবেই এই অঞ্চলটি আদিবাসী অধ্যুষিত। আদিবাসিদের বলা হয় সর্দার আর তার থেকেই সর্দারপাড়া নাম, মানে সর্দারদের পাড়া আর কি। বহু বছর ধরেই আদিবাসীরা এই অঞ্চলের বাসিন্দা, হয়ত কয়েক প্রজন্ম আগে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে এদের পুর্বপুরুষরা এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন এখানে। কিন্তু অতদিন আগে ছোটনাগপুরের পাহাড় জঙ্গল ছেড়ে এই বাদাবনে, যেখানে জলে কুমীর আর ডাঙ্গায় বাঘ সেখানে কেনই বা কি উদ্দেশ্য নিয়ে যে এঁরা এসে পড়েছিলেন সেটা গবেষণার বিষয় হতেই পারে। কিন্তু এই মানুষগুলি এখানে ঘর বাঁধার পর বহু বছর ধরে এঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর লোকাচার বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি বয়ে যেতে থাকে। এখানে কেউ কারুর স্বতন্ত্রতা না হারিয়েও এক ধরনের মেলবন্ধন তৈরী হয়ে গেছে। তাই ভাটিয়ালির পাশাপাশি এ অঞ্চলে শোনা যায় ধামসা মাদলের বোল, বনবিবির পালা আর ঝুমুর গানের সঙ্গে মিশে যায় টুসুগানের সুর।নবান্ন উৎসবের উদ্দীপনায় লাগে বাঁধনা পরবের রঙ, আর আসর বসে মোরগ লড়াইয়ের।
ইচ্ছা ছিলো এই মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপ জমানোর আর জানার চেষ্টা কিসের টানে তাদের পুর্বপুরুষরা এসেছিলেন পাহাড় আর শাল পিয়ালের জঙ্গল ছেড়ে নদীঘেরা এই বাদাবনের দেশে।ধীমান আশ্বাসও দিয়েছিলো নিয়ে যাবে কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালো সময়টাই। তাই এটাও তোলা রইল পরেরবারের জন্য।
“প্রসুণ” কিন্তু আমাদের মুগ্ধ করেছে। একবিঘার ওপর জমিতে যেন অচিনপুরের বাড়ী। গেট পেরিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে দুটি ঘর, আর একটি সবে গড়ে উঠছে, ডানদিকে একটা মঞ্চ।পিছনে একটি পুকুর আর তার পরেই ধীমানের নিজের হাতে গড়ে তোলা শাল আর ইউক্যালিপ্টাসের বন। ফনফন করে বাড়ছে গাছ। সামনের মাটির ঘরে খড়ের চালা, কিন্তু ভিতরে আরামদায়ক বন্দোবস্ত। বড় ঘর, দুটি করে ডাবল বেড,এক এক ঘরে চারজন আরামসে হাতপা ছড়িয়ে থাকার মত। বাথরুমে কমোড, বেসিন সবই মজুদ, মায় ঘরে এলইডি টিভি পর্যন্ত। যদিও সেটা চালানোর কোন তাগিদ বোধ করি নি।
Homestay Prosun at Patghara Village |
Homestay Prosun at Patghara Village |
এতো গেল নেহাতই ইঁট কাঠ আর উদ্ভিদের গল্প। কিন্ত আসল যেটা পেয়ে মন ভরে গেছে আর যেটার গভীরতা মাপার সাহস বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই সেটা হল আতিথ্যের উষ্ণতা।আমাদের থাকার প্রতিটি মুহুর্তের খেয়াল যেভাবে ধীমান এবং তার সঙ্গীরা রেখেছে, বিশেষ করে ধীমানের ছায়াসঙ্গী পচা, তাতে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করার ইচ্ছা আমার নেই। পচা আর তার বন্ধুরা যেভাবে প্রবল উৎসাহ নিয়ে আমাদের সঙ্গে জলে জঙ্গলে, হেঁটে, ইঞ্জিন ভ্যানে আর নৌকায় টৈ টৈ করেছে, ঝিঙেখালির জঙ্গল আর সামশেরনগর চিনিয়েছে তা অনবদ্য।
আর পেটুক মানুষের আসল কথাটা না বললেই নয়। এই দুইদিনে যে হারে পেটপুজো করেছি তাতে আমি নিশ্চিত কম করে তিন কেজি ওজন বৃদ্ধি করে এসেছি (এবং সেটা দস্তুরমতো বেশ অনেক পথ হাঁটাহাঁটি করার পরও)। আমি আর সুমিত দুজনের খাওয়ার বহর বকরাক্ষসের ঈর্ষার কারণ হতে পারত। আর হবে নাই বা কেন, প্রথমদিন দুপুরে শুরুই হলো গরম ডাল, ভাতের সঙ্গে দেশী মুরগীর ঝোল আর বাগদা চিংড়ীর মালাইকারী দিয়ে। সন্ধ্যেবেলা জলযোগ সদ্য ধরা ভেটকি আর আমুদি মাছ ভাজা আর রাত্রে হাঁসের মাংস। পরের দিন দুপুরে আবার কাঁকড়ার ঝোল দিয়ে ভাত। গীতাদি মানে গীতা বৈদ্য, যিনি রেঁধেছিলেন আমাদের জন্য এই দুদিন, উনি যে উঁচুদরের শিল্পী এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, হাতে যাদু আছে। কাঠের আঁচে এই রান্না বহুদিন মুখে লেগে থাকবে। এই আনন্দ বোঝানোর জন্য আমার ভাষায় কুলোবে না, টেনিদার স্মরণ নিতেই হবে, মানে একেবারে যাকে বলে ডিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস, ইয়াক ইয়াক।
Gita Baidya the culinary artist at work |
এর পরে রয়ে গেলো ঝিঙ্গেখালি জঙ্গল আর সামশেরনগরের গল্প।
পৌঁছানোর পর কব্জি তো দুরের কথা, আমি আর সুমিত প্রায় কনুই পর্যন্ত ডুবিয়ে দুপুরবেলা খেয়েছি। তারপর দুজনের অবস্থা হল সদ্য আস্ত হরিণ গেলা অজগরের মতো। শরীর বিছানা চাইছে, কিন্তু হাতে সময় বড় কম, যা পারি দেখে নিতে হবে সন্ধ্যে হবার আগেই। কাল শুধু সকালটা পাব, দুপুরবেলাতেই ফেরার পথ ধরতে হবে। অতএব দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, মনের জোরকে প্রায় শেষ সীমায় নিয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আজকের গন্তব্য ঝিঙ্গেখালির জঙ্গল আর ওয়াচটাওয়ার। সঙ্গে চললো ধীমানের বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট পচা, আমাদের গাইড হয়ে। তখন বৃষ্টিটা সবে ধরেছে, শীতের বিকেলের মরা আলো বেরিয়েছে। এবার আমরা সওয়ারী ইঞ্জিন ভ্যানে। ঝকঝক আওয়াজ করতে করতে, চীনে ডিজেল ইঞ্জিনের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, গ্রামের পথ বেয়ে চললো আমাদের বাহন। পাটঘরা গ্রাম ছাড়িয়ে পাঁচ ছ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে যোগেশগঞ্জ বাজার, আমরা এসেছিলাম এই পথ ধরেই। যোগেশগঞ্জ চৌমাথা থেকে সোজা রাস্তা গেছে কালীতলা বাজার। আমাদের গন্তব্য সেখানেই। কালীতলা বাজারে যখন নামলাম দিনের আলো প্রায় মরে এসেছে। মেঘ প্রায় কেটে গেছে বলে সুর্যদেব উঁকি মারতে শুরু করেছেন।
কালীতলা বেশ জমজমাট বাজার, দোকানপাট, বাজার বসেছে, সব্জি থেকে মাছ সবরকমেরই, লোকজনের হাঁকাহাঁকিতে সরগরম। নেমেই দৌড়লাম ফেরিঘাটে। ভারী মজার জায়গা, এপাশে এতো মানুষের ভীড়, আলো, হইহল্লা, কিন্তু নদীর ওপারে সুন্দরবনের ঘনসবুজ গম্ভীর গা ছমছম করা জঙ্গল।একটা সরু নদীর এপার আরে ওপারের মধ্যে কি আশ্চর্য বৈপরিত্য। ঘাটে দাঁড়িয়েই দেখলাম, ওপারের জঙ্গল নাইলনের জাল দিয়ে ঘেরা। সুন্দরবনের এই অঞ্চলেই বোধহয় বাঘে আর মানুষের এতো কাছাকাছি সহাবস্থান। আমাদের মতো শহরের লোকের পক্ষে কল্পনা করা মুশকিল অষ্টপ্রহর কি বিপদের সঙ্গে এই অঞ্চলে মানুষ ঘর করেন।বাড়ির পাশেই সাক্ষাৎ দক্ষিণ রায়ের আস্তানা।নাইলনের জালে বাঘ আটকায় কিনা কে জানে, আমার তো দেখে কিছুই ভরসা হলও না। প্রায়ই বাঘ বেরোনর খবর আসে।প্রতি বছর মৃত্যুও ঘটে, সরকারী খাতায় সেগুলো শুধু পরিসংখ্যান হয়েই থেকে যায়।
ঘাটে ইতিউতি কিছু নৌকা বাঁধা, দুটো ছোট মোটর লঞ্চ। সামনে নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে সেটা পেরোলেই ঝিঙ্গেখালি ওয়াচটাওয়ারের ঘাট, মেরে কেটে দশ মিনিটের নৌকা যাত্রা। কিন্তু একি কান্ড, কেউই দেখি নিয়ে যেতে রাজি নয়। কেন, নাকি আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি, পৌঁছতে পৌঁছতে টাইম পেরিয়ে যাবে। আর তার পরে ঝিঙ্গেখালি ঘাটে নৌকা ভিড়লে বনবাবুরা গোঁসা হবেন, আর আইন না মানার ফাইনও নাকি আছে। অতএব সব্বাই একযোগে ঘাড় বেঁকিয়ে বসে।অনুরোধ উপরোধেও চিঁড়ে ভিজলো না।তীরে এসে তরী ডোবার এটাই বোধহয় আদর্শ উদাহরণ। পচার মুখটাও একটু শুকনো, আমাদের দুই শহুরে প্রানীকে এতদূর ঠেঙ্গিয়ে নিয়ে এসে জঙ্গলের দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সেটা ওরও ঠিক হজম হচ্ছে না। তারপর সুমিতের কাঁধে বোম্বা লেন্স, ছবি শিকারের জন্য তৈরি কিন্তু বিধি বাম বলেই মনে হচ্ছে। অতএব অগতির গতি হিসাবে পচা আবার ঘাট থেকেই ফোনে ধরল ধীমানকে। দুচার কথা বলেই বললো দাদাকে বলেছি কথা বলতে, একটু দাঁড়ান। আমরাও নেই কাজ তো খই ভাজ বলে ইতিউতি হযবরল ছবি তুলতে লাগলাম, এমনকি সেলফি অবধি। পাঁচ মিনিট পরেই ধীমানের ফোন পচার মোবাইলে, ব্যাবস্থা নাকি হয়ে গেছে, জঙ্গলে নামা যাবে। এবার পচা বীর দর্পে ঘাটে নেমে মাঝিদের বলল ছাড়ো নৌকা সব কথাবার্তা হয়ে গেছে, লাইন ক্লিয়ার। মাঝিদের ধন্ধ তবুও যায় না, ঝোপ বুঝে কোপ হিসেবে ভাড়া হাঁকলো দুশো টাকা।দশ মিনিটের যাত্রার জন্য যা অবশ্যই গলাকাটা। কিন্তু উপায় নেই দায়টা আমাদেরই। সেইজন্য ফাঁদে পড়ে বগা কান্দে রে করে দুশোটি টাকাই কবুল করা গেলো। নৌকায় উঠতেই ঝপ করে আর একজন মাঝবয়সি মানুষ উঠে পড়লেন, জানলাম উনি গাইড, জঙ্গলের পথে এনার উপস্থিতি নাকি মাস্ট।
Kalitala Ferryghat |
Kalitala Ferry Ghat |
শুরু হলো নৌকাযাত্রা, বাঁক ঘুরতেই, সহসা দশগুণ হয়ে গেলো নদীর বিস্তার, একদিকে ঝিঙ্গেখালির গভীর জঙ্গল, অন্যদিকে বহুদুরে আবছা ধুসর তটরেখা। ওদিকটা বাংলাদেশ, সেদিকেও ঘন জঙ্গলের আভাস। বেশ কিছুটা তফাতে অলস গতিতে ভেসে যাচ্ছে বাংলা দেশের পতাকা লাগানো একটা জাহাজ।পশ্চিম আকাশে তখন সুর্যাস্তের খুনখারাপী রঙের হোলি খেলা। দুচোখ ভরে দেখছি শুধু।এর মধ্যেই নৌকা ঝিঙ্গেখালি ঘাটে। কিন্তু অবস্থা দেখে চক্ষু চড়কগাছ, নামবো কিভাবে? ভাঁটার টানে জল নেমে গেছে আর তীর জুড়ে থকথকে কাদা, জেটিতে ওঠার আগেই হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডূবে মরব। আমরা কাদা ঘাঁটতে রাজী নই, অতএব উপায়? দেখা গেল আর একটা বোট ভীড়েছে জেটিতে, তার নাকটা ঘাটের সিঁড়িতে ঠেকানো। আমদের মাঝিভাই অনেক চেষ্টা চরিত্র করে, নিজে জলে কাদায় নেমে, নিজের বোটকে নানা কসরতে অন্য বোটটার গায়ে ঠেকিয়ে দিলেন।আমরা ক্যামেরা, জলের বোতল সামলে, হাঁচর পাঁচড় করে ব্যালান্সের খেলা দেখিয়ে অন্য বোটটা পেরিয়ে অবশেষে ডাঙ্গায় পা রাখলাম। নেমে নিজেদের পুরো কলম্বাস মনে হল।
On the way to Jhingekhali watch tower Sundarban |
The vast expanse of river Raimangal near Jhingekhali Forest Range Sundarban |
View of Jhingekhali Forest Range Sundarban |
The Ferry Ghat at Jhingekhali Watch Tower Sundarban |
ঘাট থেকে উঠেই বনদপ্তরের বিশাল কম্পাউন্ড,বাহারী ফুলের গাছ, কেয়ারী করা বাগান, একটা পুকুর আর শেষ প্রান্তে তিনতলা ওয়াচটাওয়ার। একজন বনকর্মী জানালেন আমরা অলরেডী লেট, অতএব সময় বরাদ্দ ঠিক দশ মিনিট। তাই সই, কারণ তখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে, কিছু দেখতে পাওয়ার আসাও ক্ষীন।উঠলাম ওয়াচ টাওয়ারে, সামনে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিপুল বিস্তার। সামনে একটা জলাশয়। তার পিছনে বেশ কিছুটা জঙ্গল পরিস্কার করা, বন্যপ্রানীরা জল খেতে এলে যাতে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নজরে আসে। বহু পাখীর ডাক শোনা যাচ্ছে, জঙ্গলে দ্রুত নেমে আসছে অন্ধকার। দুরবীন দিয়ে ইতিউতি দেখার চেষ্টা করলাম, নজরে এলো না কিছুই, এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে, সুতরাং ক্যামেরা বাইনোকুলার গুটিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। আপসোস বিশেষ নেই, এই মায়াবী বিকেলে সুন্দরবনের যে ভাবগম্ভীর রূপ দেখলাম, মস্তিষ্কের হার্ড ডিস্কে সেভ হয়ে থাকবে চিরকাল।
View from Jhingekhali Watch Tower Sundarban |
ফেরার পথে কালীতলা বাজারে চা খেয়ে, সিগারেট ফুঁকে আমাদের তিনচাকার যন্ত্রবাহনে আবার পাটঘরার পথে। সন্ধ্যেবেলা নাকি আমুদি মাছ আর ভেটকি মাছ ভাজার বন্দোবস্ত। আর ডিনারে হাঁসের মাংস আর ভাত। জয়গুরু।
পরের দিন সকালে অভিযান শেষপ্রান্ত সামশেরনগরে।
সামশেরনগর নিয়ে কিছু কিছু লেখা পড়েছিলাম কয়েকটি ভ্রমণ বিষয়ক পত্রপত্রিকায়। সেসব বর্নণা শুনেই ঠিক করেছিলাম এখানে আসবোই।
দ্বিতীয় দিন আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়লাম।আমরা সওয়ারি তিন চাকার ইঞ্জিন ভ্যানে। ধীমানের বাড়ি থেকে সামশেরনগর ঘন্টাখানেকের পথ। চা খেয়ে উঠে পড়া গেল আর সারথি স্টার্ট দিলেন। ডিসেম্বরের শেষে হাওয়ায় ঠান্ডার কামড়। প্রথমে পড়ে কালীতলা বাজার। গতকাল এখান থেকেই বোটে করে গিয়েছিলাম ঝিঙ্গেখালির জঙ্গলে।এবারে ভ্যান কালীতলা ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল সামশেরনগরের পথে। বাজার ছাড়ালেই ফাঁকা রাস্তা। রাস্তাটা ভারি সুন্দর, ডানপাশে একটা খাল আমাদের সঙ্গী হয়েছে। খালের ঠিক ওপারেই ঘন ম্যানগ্রোভের জঙ্গল।পাড়ে কাদায় অসংখ্য শ্বাসমুল মাথা তুলে আছে। কাদায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দুধসাদা বকের দল। ইঞ্জিনভ্যানের একঘেয়ে ঝক ঝক আওয়াজ ছাপিয়ে জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে অজানা পাখিদের কলকাকলি।পুরো রাস্তাতেই আমাদের সঙ্গী এই খালটা। আমাদের বাঁদিকটা ফাঁকা, ফাকা বেশীরভাগটাই মাঠ আর চাষের জমি। কখনওবা পেরিয়ে যাচ্ছি ছোট ছোট গ্রাম আর জনবসতি, মাটির ঘর, ছোট দোকান, মাঝে চোখে পড়ল একটা বনবিবির থান।
View on the way to Samshernagar Sundarban |
Bonbibi Temple Samshernagar Sundarban |
এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সামশেরনগর। কালিন্দী আর রায়মঙ্গল নদী দিয়ে ঘেরা ভারত ভুখন্ডের প্রায় শেষ প্রান্ত। কালিন্দী নদীর প্রান্তে জিরো পয়েন্ট থেকে ঝাপসা নজরে আসে বাংলাদেশের সীমানা। সীমান্ত অঞ্চল হওয়ার জন্য অবশ্যই স্পর্শকাতর এলাকা, বি এস এফের বিরাট ক্যাম্প রয়েছে আর নদীর ধারে উচুঁ ওয়াচটাওয়ার।হিসেবমত সামশেরনগরের জনবসতি অনেক পুরোন, আসার পথে পড়ল সামশেরনগর স্কুল, দেখলাম দেওয়ালে সিমেন্ট দিয়ে প্রতিষ্ঠা সন দেওয়া আছে ১৯৫৮। তার মানে এর অনেক আগে থেকেই এখানে মানুষের বসবাস।চিন্তা করার চেষ্টা করলাম সেই সময় সামশেরনগরের রূপ ঠিক কেমন হতে পারে, জঙ্গল তখন নিশ্চয়ই ছিল আরও ঘন, আরও ভয়ঙ্কর, বাঘের আনাগোনাও ছিল অনেক বেশী।আর বাঘ আটকানোর জাল তো এই হালে লেগেছে। তার মানে সেই কোন কাল থেকেই এই দুর্গম বাদাবনে জলে কুমীর আর ডাঙ্গায় বাঘ নিয়ে মানুষের জীবনসংগ্রাম শুরু।
এখনও সামশেরনগরের মজা এটাই, জঙ্গল আর লোকবসতি এখানে পাশাপাশি, প্রায় হাত ধরাধরি করে, মাঝখানে ব্যাবধান বলতে শুধু শকুনখালি নদী। তাও তাকে নদী বললে বেশী বলা হয়, খাল বলাই ভালো। চওড়ায় হয়ত মেরেকেটে হাত ত্রিশেক। ওপারেই গা ছমছমে গভীর ম্যানগ্রোভ অরন্য, এত ঘন যে ভরা দিনের আলোতেও দৃষ্টি চলে না ভিতরে।বনদপ্তর থেকে পুরোটা ঘিরে রেখেছে নাইলনের জালে যাতে বাঘ টপকে এপারে আসতে না পারে।কখনও কখনও গভীর রাতে মাটির ঘরে শুয়ে থাকা মানুষের আচমকা ঘুম ভাঙ্গে ওপারের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা বাঘের গম্ভীর ডাকে। এই বন্য পরিবেশে, রাতের অন্ধকারে, পলকা মাটির ঘরে শুয়ে সে ডাক যে শুনেছে সেই জানে শুধু সেই আওয়াজেই কিরকম ভাবে রক্ত জল হয়ে যায়।কখনো বা গ্রামের পথে ভিজে কাদা মাটিতে দেখা যায় তাঁর পায়ের ছাপ, শুধু নাইলনের জাল কি ঠেকিয়ে রাখতে পারে বনের রাজাকে।
যতই হোক না ভয়ঙ্কর, এই জঙ্গলকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এখানকার মানুষগুলির জীবন। সবারই দিন গুজরান হয় সারাদিন নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরে বা জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ করে। সুন্দরবনের এই অঞ্চলে চাষবাস বিশেষ কিছু হয়ই না, পেটের ভাত জোগায় এই জঙ্গলই আবার হামেশাই এই জঙ্গলই কেড়ে নেয় বহু প্রাণ। যেহেতু জীবন এখানে এত জঙ্গলকেন্দ্রিক, তাই হয়ত বাঘে মানুষে মোলাকাতের সংখ্যাও এখানে বেশ বেশি। তাই মাঝে মাঝেই প্রিয় মানুষটি জঙ্গলে গিয়ে আর ফেরে না, কুঁড়েঘরে ওঠে কান্নার রোল। হতভাগ্য মানুষটির সঙ্গীরা নিঃশব্দে গ্রামে ফিরে আসে মাথা নিচু করে, কখনোবা আধখাওয়া ছিন্নভিন্ন দেহটা কাপড়ে জড়িয়ে।খুব অল্প কিছু সৌভাগ্যবানই জীবিত ফেরে, সাক্ষাৎ মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে।কোনক্রমে প্রাণটা নিয়ে ফিরলেও যমে মানুষে টানাটানির পর শরীরে গভীর ক্ষতের দাগ আর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় বাকিটা জীবন।কিন্তু কোন মৃত্যুই এখানে জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারে না। জীবন এখানে কঠিন, দারিদ্র নির্মম, তাই শোকের সময়ও এখানে সীমিত। চোখের জল মুছে মৃতের নিকটজনকে আবার সেই জঙ্গলেই ফিরতে হয় পেটের দায়ে, প্রাণ হাতে করে।
সামশেরনগর দেখতে গেলে একমাত্র উপায় হচ্ছে হাঁটা। পৌঁছে আমরা ভ্যান ছেড়ে দিলাম। চালক এখানেই আমাদের ফেরার অপেক্ষায় থাকবেন। আমরা গঞ্জের মধ্যে অল্প হাঁটা পথ বেয়ে শকুনখালি নদীর ধারে উঁচু মাটির বাঁধে এসে উঠলাম। এবার শকুনখালির তীর ধরে বাঁধের ওপর দিয়ে সোজা হাঁটা।সামশেরনগরকে চিনে নেওয়া এভাবেই। হাঁটাপথে আমাদের বাঁদিকে গ্রাম্যজীবনের চলমান ছবি।কোথাও মাটির ঘরে আঙ্গিনাতে চলছে ধান ঝাড়া, কোথাওবা চলছে জাল বোনা। কোনে ডাঁই করা খড়ের আঁটি।মাদুর পেতে বাচ্চারা বসেছে পড়তে, কয়েকজন আবার হুটোপাটি করে বেড়াচ্ছে। তারে শুকোচ্ছে রংবেরঙের শাড়ী, জামাকাপড়, মাটির উনুনে আঁচ পড়েছে, হাঁড়িতে ফুটছে ভাত।দাওয়াতে বৃদ্ধ,বৃদ্ধারা চাদর মুড়ি দিয়ে রোদ পোহাচ্ছেন। ওদিকে শকুনখালির তীর জুড়েও ব্যাস্ততা। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চলেছে মাছ ধরা, কিছু নৌকা লেগেছে উল্টোপারে জালছাওয়া জঙ্গল ঘেঁষে।বড্ড যেন কাছে। দেখে একটু শিহরণ বোধ হয় আর কি, এমনকি এই পরিষ্কার দিনের আলোতেও।মনে হয় যেকোন সময় জঙ্গল ফুঁড়ে দেখা দিতে পারেন দক্ষিণরায়। আমরা তো দাঁড়িয়ে আছি তাঁর সাম্রাজ্যেই।এখানের এই গা ছমছমে ভাবটাই একটা দারূন অভিজ্ঞতা।
The path beside river Shakunkhali, samshernagar, Sundarban |
Life at Samshernagar Sundarban |
Life at Samshernagar |
Life at Samshernagar Sundarban |
Kids Studying Samshernagar Sundarban |
খালে নৌকার ঝাঁক তো আছেই, কেউ কেউ তীরে দাঁড়িয়েই হাতজাল ফেলে মাছ ধরছে। বেশ কিছু মহিলা দেখলাম কোমর জলে নেমে জাল জাতীয় জিনিস নিয়ে জল ঠেলে হাঁটছেন। জিজ্ঞাস করতে জানা গেল কাঁকড়া ধরা চলছে। এখানে দেখে বুঝলাম স্ত্রী, পুরুষ ভেদাভেদ নেই, বাইরের কাজে সবাই হাত লাগিয়েছে। নৌকাতে ছেলেদের সঙ্গে মহিলারাও আছেন, দাঁড় বাওয়া থেকে জাল ফেলা সবেতেই, আবার ঘরকন্নার কাজেও।
Fisherman Samshernagar Sundarban |
Fishermen on boat at the backdrop of the forest |
Life goes on at Smshernagar Sundarban |
শীতের সকালে এই হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে। দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি, শকুনখালির ধারে ধারে গাছে পাখির মেলা। হাঁটতে হাঁটতেই নজরে পড়ল দারুণ সুন্দর নীল রঙের ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচার, ডানায় ঝিলিক তোলা পার্পল সানবার্ড, স্মল মিনিভেট আর অবশ্য করেই নানারকমের রংবাহারী মাছরাঙা পাখি। কতরকম নাম তাদের, কমন কিংফিশার, কলার্ড কিংফিশার, ব্ল্যাক ক্যাপড কিংফিশার।নদীর জলে পোঁতা বাঁশের খুঁটির ওপর তারা বসে আছে আর থেকে থেকেই তীব্র গতিতে জলে ঝাঁপ দিয়ে ঠোঁটে মাছ নিয়ে উঠে আসছে।
Stock Billed Kingfisher, Samshernagar, Sundarban : Photo courtesy Sumit Biswas |
White Collared Kingfisher, Samshernagar, Sundarban :Photo courtesy Sumit Biswas |
White Breasted Kingfisher, Samshernagar, Sundarban : Photo courtesy Sumit Biswas |
Small Minivet, Samshernagar, Sundarban : Photo courtesy Sumit Biswas |
Verditer Flycatcher, Samshernagar, Sundarban :Photo Courtesy Sumit Biswas |
Small Minivet, Samshernagar, Sundarban : Photo Courtesy Sumit Biswas |
Purple Sunbird Male, Samshernagar, Sundarban: Photo Courtesy Sumit Biswas |
Verditer Flycatcher, Samshernagar, Sundarban : Photo Courtesy Sumit Biswas |
Long Toed Stint, Samshernagar, Sundarban : Photo Courtesy Sumit Biswas |
এছাড়াও আরও কতশত পাখির মেলা, আমি অবশ্য এত পাখি চিনিও না বরং এ ব্যাপারে বেশ অজ্ঞ।বন্ধু সুমিতের ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফির শখ, সে কিছু কিছু পাখী চেনালো আর বেশির ভাগ সময়টাই তার কামানের মতো লেন্স উঁচিয়ে ঊর্ধমুখ হয়ে ঝপাঝপ ছবি তুলতে লাগলো। আমার এই বাতিক অতোটা নেই, অতএব আমি নিজের মনে ঘুরতে লাগলাম ইতিউতি। এই করতে গিয়েই চোখে পড়ল, একটা উঁচু গাছের ডালে একটা ভুতুম প্যাঁচা অত্যন্ত গম্ভীর আর বিরক্ত মুখে আমাকে দেখছে। ছবি তুলতে গেলাম কিন্তু সে আমার পুঁচকে ক্যামেরার রেঞ্জের অনেক বাইরে। তবে ব্যাপার স্যাপার দেখে বুঝলাম এই জায়গাটা পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গ। পাখিরোগ থাকলে ক্যামেরা দুরবীন বাগিয়ে চলে আসতে পারেন, নিরাশ হবেন না বলতে পারি।
Photo Courtesy Sumit Biswas |
হাঁটতে হাঁটতে এবারে শকুনখালির শেষ প্রান্তে, যেখানে সে মিশেছে কালিন্দীর সঙ্গে। মোহনায় বিশাল চওড়া কালিন্দী। দুপুরের রোদে নদীর বুকে তখন লক্ষ হীরের ঝিলমিল। দূরে নদীর বুকে অসংখ্য মাছধরা ট্রেলারের ধুসর অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে হু হু করে, বাঁকের মুখে ঢেউয়ের ঝাপট আটকানোর জন্য ইঁটের বাঁধানো পাড়। তার ওপর বসলাম একটুক্ষণ, অনেকটা হাঁটা হয়েছে, আবার ফিরতে হবে একই রাস্তা ধরে। নদীর ধারে জাস্ট চুপ করে বসে থাকতে আমার বরাবরই ভালো লাগে, এখানেও তার ব্যাতিক্রম নয়। নদীর ওপারে বাংলাদেশের সুন্দরবন, চলে গেছে আরও পুর্বদিকে। জঙ্গল সেখানে আরও ঘন আরও বিশাল তার বিস্তার। পৃথিবীর সর্ব্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে জানতে হলে, এর বৈচিত্রকে বুঝতে হলে আরও অনেক অনেক সময় লাগবে। তাই আবার ইচ্ছা রইলো ফিরে আসার।
View of river Kalindi from zero point: Samshernagar Sundarban |
এবারের মতো যাত্রা শেষ। এবার ঘরে ফেরার পালা।
সঙ্গে স্মৃতি হিসাবে থাকল কিছু ছবি। সেগুলোর কয়েকটা দিলাম এখানে। না কোন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফী নয়, আমার দেখা নিতান্ত সাধারণ কিছু গ্রাম জীবনের টুকরো মুহুর্ত।
সুন্দরবনকে একটু অন্যভাবে দেখতে গেলে, অনুভব করতে গেলে আসতে পারেন এদিকে। যদিও আমি প্রথাগত ভাবে জঙ্গলে ঢুকিনি কিন্তু তার ব্যাবস্থাও আছে ধীমানের কাছে। চেনা ট্যুরিস্ট সার্কিটের বাইরে সুন্দরবনের এই অঞ্চলে এলে জঙ্গলের এক অন্য রূপ দেখতে পাবেন।থাকবে অচেনা অজানা নদীতে খাঁড়িপথে নিজের মতো ঘোরাঘুরির আর জঙ্গলকে অনুভব করার সুযোগ।সজনেখালি, সুধন্যখালির হুড়োহুড়ি, লঞ্চভর্তি মানুষের হইহল্লা, যাঁরা সুন্দরবনের সম্মন্ধে কিছুমাত্র না জেনেই শুধু ফুর্তি করতে এসেছেন, সেইসব উতপাৎ এখানে নেই। আর হ্যাঁ খালি বাঘ দেখাকে পাখির চোখ করে আসবেন না, তাতে সুন্দরবনের অসামান্য সৌন্দর্য তো কিছুমাত্র উপভোগ করতে পারবেনই না উলটে একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়ী যাবেন। মনে রাখবেন এটা রণথম্ভোর বা তাড়োবার জঙ্গল নয়। আপনার ইচ্ছায় নয়, সুন্দরবনের বাঘ তার ইচ্ছায় আপনাকে দেখা দেবে।সেইটা মেনে নিয়ে যদি আসেন আর প্রকৃতিকে ভালোবাসার সংবেদনশীল মনটা যদি থাকে, নিরাশ হবেন না।
এখানে আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই কয়েকটা মানুষের কথা যাদের আন্তরিক সাহায্য, ভালোবাসা আর পরিশ্রম না থাকলে এই ছোট্ট বেড়ানোটা এত মনগ্রাহী হত না।এদের কেউই পেশাদার গাইড, ট্যুর ম্যানেজার বা হোটেল ব্যাবসায়ী নয়, কিন্তু যে আন্তরিকতা, ভালবাসা আর যত্নের সঙ্গে আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছে, ২৪ ঘন্টা আমাদের সব সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রেখেছে এক কথায় অনবদ্য। পয়সা দিয়ে কেনা পেশাদারী আথিথেয়তার সঙ্গে এর কোন তুলনাই হয় না। পচা,তরুণ, পাপ্পু, ভোলা, কমবয়সী ছেলে সব, কিন্তু কি অসম্ভব করিৎকর্মা, আর জঙ্গল চেনানোর কি আন্তরিক প্রচেষ্টা।
থাকা আর ঘোরার বন্দোবস্তের জন্য যোগাযোগ করুন ধীমানের সঙ্গে। ঠিকানা নিচে দেওয়া রইলো।
ধীমান মন্ডল।
প্রসূণ, গ্রাম পাটঘরা
থানা হেমনগর কোস্টাল
হিঙ্গলগঞ্জ, উত্তর চব্বিশ পরগনা।
৯০৮৮০৩০৫৮৬/৯৫৪৭১৭১০০/ ৯০০৭৩৩৬৩৫৩